কোরবানীর পশু পালন, সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

0
46
Typical Kurbani Cattle market in Bangladesh

পবিত্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসবের একটি পবিত্র ঈদুল আযহা বা কোরবানীর ঈদ। প্রতি বছর আরবী জিলহজ মাসের ১০ তারিখ জামায়াতে ঈদের নামাজ আদায়, তৎপর পশু কোরবানী দেওয়া শুরু হওয়ার পর মোট ৩ দিন পশু কোরবানী করা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশে কোরবানীর ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠে কোরবানীর পশু ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুসলিমদের চাহিদা অনুযায়ী দেশে কোরবানীর পশু পর্যাপ্ত না থাকায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ গরু আনা হয় অবৈধপথে। ঈদের পূর্ববর্তী সময়ে ভারত থেকে গরু আনার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও চিত্র দেখার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা নিশ্চিত করে যে, প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ গরু আসে কোরবানী উপলক্ষে ভারত থেকে।

 

প্রান্তিক কৃষক কর্তৃক গরু, মহিষ ও ছাগল পালনের পাশাপাশি শহরভিত্তিক বড় বড় ব্যবসায়ি এবং ক্ষুদ্র মাঝারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে গরু, মহিষ ও ছাগল লালন পালন পূর্বের তুলনায় বাড়লেও বাংলাদেশে কোরবানীর পশুর ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে কোরবানের ঈদে পশুর দাম অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কোরবানী ত্যাগের উৎসব হওয়ায় পশুর রং, গঠন ও দেখাশুনায় পছন্দ হলে অনেকেই বেশি দামেও ক্রয় করেন, এটি ব্যতিক্রম ঘটনা ধরে নিলেও গরু, মহিষ-ছাগলের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ পশু না থাকা। কোরবানীর পশুর এই ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি বছরব্যাপী চড়া মূল্যে বিক্রয় হওয়া গরুর মাংসের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে এবং মাংস আমদানী কমিয়ে দেশীয় গরু-মহিষ দিয়েই নিজেদের মাংসের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করার জন্য পশু পালন সম্ভাবনাময় একটি খাত হতে পারে।

 

স্বশিক্ষিত, প্রাথমিক জ্ঞানসম্পন্ন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষিত কর্মসক্ষম বেকার দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশে। বেকারত্ব চিন্তার বিষয় হলেও বাংলাদেশের মানবসম্পদ সমস্যা নয়, সম্পদ। বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যার সিংহভাগই মুসলিম হওয়ায় বাংলাদেশে গরু ও মহিষের মাংসের পাশাপাশি সকল ধর্মের মানুষের জন্য ছাগলের মাংসের ব্যাপক চাহিদা থাকায় তরুণদের মধ্যে একটা অংশকে পশু পালনে আগ্রহী করে তোলার বিকল্প নেই। কৃষি কাজের অন্যতম খাত পশু পালনে তরুণদের আগ্রহী করে তোলার জন্য তাদেরকে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি ন্যুনতম ২.০০ লক্ষ টাকা ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। বেকার নাগরিকদের মধ্যে যারা গ্রামে বসবাস করেন, তাদের জন্য পশু লালন পালন শহরে বসবাসকারী নাগরিকদের তুলনায় কিছুটা হলেও সহজ। কেননা গ্রামে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পশু খাদ্য পাওয়া যায়। নব্বই দশকের সময়ের মতো গৃহপালিত পশু সকালে বিলে ছেড়ে দিয়ে কিংবা ঘাসের জায়গায় খুটি গেড়ে রেখে এসে, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরানোর সময়টা এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও গ্রাম এখনো গৃহপালিত পশু লালন পালনের জন্য আদর্শ জায়গা।

 

গৃহপালিত পশু লালন পালন করে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ অর্থাৎ লোকসানের শিকার হয়েছে বলে তেমন কোন তথ্য পেপার পত্রিকা কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে জানতে পারিনি। তবে সখের বশে বিপদের আশংকা জেনেও যারা বিশাল আকৃতির গরু লালন পালন করেন অর্থাৎ ৩০-৪০ মণ ওজনের গরু তৈরী করতে চান, এটি অনেকটাই ঝুকিপূর্ণ। গত বছরও বিশাল আকৃতির একটি গরু বিক্রয়ের পূর্বেই মারা যায়। এতে মালিকের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হলেও এই ধরনের ঝুকি নিয়ে পশু পালন কাম্য নয়। এছাড়া উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের সহায়তা নিয়ে গৃহপালিত পশু পালনে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর গল্পই আমরা বেশি শুনতে পাই। সমাজের কথিত মতে এটি কোন ছোট পেশা নয়। এটি অবশ্যই একটি সম্মানজনক পেশা। এই পেশায় প্রতি বছরই অনেকে যুক্ত হচ্ছে এবং আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। বড় বড় শিল্পপতিরাও তাদের চলমান ব্যবসার সাথে এগ্রো ফার্ম যুক্ত করছে। পশু পালনের কাজে বহু মানুষ সম্পৃক্ত হলেও এই খাতে আরো বিনিয়োগকারী প্রয়োজন।

 

গ্রাম এলাকায় ৩০-৪০ হাজার টাকার মধ্যে মোটামুটি মানের ছোট গরু কেনা যায়। এই ধরনের ৫টি বাছুরকে যদি বছর জুড়ে লালন পালন করে উপযুক্ত হওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী কোরবানী কিংবা যেকোন সময় বিক্রয় করা যায়, তাতে করে সকল খরচ শেষে উল্লেখযোগ্য একটা অংশ লাভ হিসেবে থাকে। এছাড়া গাভী লালন পালন করলেও পরবর্তীতে বাছুর দিলে দুধ বিক্রয় করা যায়। গাভি বাছুর দেয়া মানেই বাড়তি লাভের একটা হিসেব থাকে। এছাড়া শুধু কোরবানীর বাজারই নয়, বছর জুড়েই গরুর মাংসের ব্যাপক চাহিদা এবং চড়া মূল্যে মাংস কিনে খেতে হয়। গ্রামে কিংবা শহরে গরু জবাই করে ক্রেতার অভাবে বিক্রয় হয়নি, এমন কোন নজির নেই। শুধু কোরবানী কেন্দ্রিই নয়, বছর জুড়েই গরু, মহিষ, ছাগল ছাড়াও হাঁস মুরগীর ব্যাপক চাহিদা থাকে। এই চাহিদা পূরণে দেশীয় জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এদিকটায় মনযোগ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং বেকার নাগরিকদের নিজে কিছু করার তাড়না থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তরুণদের একটা অংশকে গৃহপালিত পশু লালন পালনে আগ্রহী করে তোলতে পারলে নাগরিকদের মাংসের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশ থেকে বেকারত্ব দূর করা কিছুটা হলেও সম্ভব হবে।