ফুটবলে সবকিছু সম্ভব। অসম্ভব বলে কিছু নেই। তাই ম্যাচের আগেই পরাজিত বলে কোনো শব্দও নেই। কিন্তু ম্যাচটা যখন চ্যাম্পিয়ন্স লীগের, তখন অসম্ভবকে সম্ভব করা আরো সহজ হয়ে যায়। পুরনো ইতিহাস, বিগত দিন শুধু এই অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্পই শোনায়। ঠিক তেমনি এক অসম্ভবের গল্প লিখতে বার্নাব্যুর উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় চেলসি। স্টেজ হচ্ছে কোয়ার্টার ফাইনাল। প্রতিপক্ষ চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সবচেয়ে সফল দল রিয়াল মাদ্রিদ। তার উপরে প্রথম লেগে ৩-১ গোলে পিছিয়ে।
বার্নাব্যুতে ২ গোলে পিছিয়ে মাঠে নামা মানে একপ্রকার মান বাঁচানোর ম্যাচ। কোনো আশা নেই। হেরেই গেছি এমন। চেলসির কোচ টমাস টুখেলও ঠিক এমনটাই মনে করেছে ম্যাচের আগে। ম্যাচের পূর্বে টুখেলের স্পষ্ট জবাব, আমরা অলরেডি ছিটকে গেছি। তবে, এটা যে টুখেলের মাইন্ড ছিলো তা ম্যাচ দেখেই বুঝা যায়। আমরা ম্যাচে নেই, আমাদের সেমিতে যাবার কোনো চান্স নেই, টাই অলরেডি ওভার, এমন সব কথা বলে মাদ্রিদের সাথে মাইন্ডগেমটা খুব ভালোভাবেই খেলেছে টুখেল।
তবে, চেলসি সে যাই মাইন্ডগেমই সাজাক না কেনো, প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদ। প্রথম লেগে স্টামফোর্ড ব্রীজে রিয়াল মাদ্রিদের দাপুটে জয়ই জানান দেয়, এই স্টেজে মাদ্রিদ কতটা ভয়ংকর, কতটা ক্ষিপ্র। স্টার্টিং লাইনআপের দিকে ফোকাস করা যাক। রিয়াল মাদ্রিদের গত লেগের একাদশ নিয়েই স্টার্ট করেছিলো। টিমে ভালভার্দে থাকা কতটা দরকারি, তা হয়তো আনচেলত্তির মাথায় অবশেষে ঢুকেছে। সাসপেন্সের কারণে মিলিতাও এর জায়গায় স্টার্টার হিসেবে ছিলো নাচো হার্নান্দেজ। তার সঙ্গী ডেভিড আলাবা। রাইট ব্যাক এবং লেফট ব্যাকে মেন্ডি ও কার্ভাহাল। মিড ত্রয়ী ক্রুস, ক্যাসেমিরো ও মড্রিচ৷ লেফট উইং এ ভিনি, রাইট উইঙ্গার ভালভার্দে এবং নাম্বার নাইন করিম বেনজেমা।
চেলসির আক্রমণের পসরা একটু ভিন্ন ছিলো। প্রথম লেগের তিন জনকে এবার সাব হিসেবে রেখেছে টুখেল। জর্জিনহোর জায়গায় কোভাচিচ, এজপেলিকোয়েতার জায়গায় রুবেন এবং পুলিসিচের পরিবর্তে ওয়ার্নার। চেলসি যে প্রথম থেকেই একেবারে মরিয়া হয়ে গোলের জন্য খেলবে তা কোভাচিচ এবং ওয়ার্নারের টিমে ইনক্লুড হবার পরই বুঝা যাচ্ছিলো। যেহেতু ৩-১ গোলে এগিয়ে খেলা শুরু করেছে রিয়াল, সেহেতু স্বভাবতই আনচেলত্তি ডিফেন্সিভ খেলাবে। সেভাবেই এগুচ্ছিলো। চেলসির একের পর এক আক্রমণ নশ্চাৎ হতে থাকলে লিড নিতে বেশি দেরি করেনি চেলসি। ওয়ার্নারের এসিস্টে লক্ষ্য ভেদ করে মেসন মাউন্ট। দরকার আর ১ গোল, তাহলেই সমান হবে।
কিন্তু বিরতি পর্যন্ত কোনো পক্ষই আর গোলের দেখা পায়নি। বিরতি থেকে ফিরে চেলসি দেখালো তাদের রূপ। ফুটবলে যে সবকিছুই সম্ভব, তা চেলসি আরো একবার মনে করিয়ে দিলো। মিলিতাও না থাকায় এমনিতেই এরিয়ালে ভুগছিলো রিয়াল। নাচোর হাইট কম হওয়ায় এরিয়ারে বার বার ভুল করতে থাকে। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় চেলসির ডিফেন্ডার রুডিগার। মেসন মাউন্টের বাঁকানো কর্নারের বল হেড করে জালে ঢুকায় রুডিগার। সেই সাথে চেলসি ব্যাক করে। ম্যাচ দাঁড়ায় ৩-৩ এগ্রিগ্রেটে। ম্যাচের ৬৩ মিনিটেই লিডে যেতে পারতো চেলসি। কিন্তু আলোনসোর গোল ভিএআরে বাতিল হলে, তাদের তখন আর লিডে যাওয়া হযে উঠে না। এক চেটিয়া চেলসির আক্রমণে দিশেহারা হয় রিয়াল। ৭৫ মিনিটে টিমো ওয়ার্নারের গোল চেলসি লিডে নিয়ে যায়। এগ্রিগ্রেটে ৪-৩ এ এগিয়ে সেমিফাইনালের গল্প লিখতে বসে চেলসি। মাদ্রিদ যেনো একেবারে ছন্নছাড়া। বাকি মাত্র ১৫ মিনিট, রিয়ালের খেলায় গোল দেবার সমূহ সম্ভাবনা খুব একটা নেই। চেলসি ততক্ষণে ফুরফুরে।
কিন্তু প্রতিপক্ষতো রিয়াল মাদ্রিদ৷ কয়েকদিন আগেও পিএসজির বিপক্ষে কামব্যাক করা রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এই পনেরো মিনিট অনেক বেশি সময়। তার উপরে ম্যাচটা বার্নাব্যুতে। পিছিয়ে পরেও কামব্যাকের হাজারো গল্প এখানে লিখা আছে। ম্যাচে ফিরতে মাদ্রিদের লেগেছে মাত্র পাঁচ মিনিট। মড্রিচের চোখ ধাঁধানো এসিস্টে রদ্রিগোর ট্যাপ ইন মাদ্রিদকে ম্যাচে ফেরায় ৮০ মিনিটে। এগ্রিগ্রেট দাঁড়ায় ৪-৪। যথারীতি খেলা গড়ায় এক্সট্রা টাইমে। প্রথম লেগের হিরো দ্বিতীয় লেগেো হিরো হতে সময় নেয়নি বেশিক্ষণ। ম্যাচের ৯৬ মিনিটে ভিনিসিয়াসের এসিস্টে দারুণ এক হেডারে দলকে লিড দেন করিম বেনজেমা। এবারে টুর্নামেন্টে তার গোল দাঁড়ায় ১২ টিতে। বাকিটা সময় চেলসি একের পর এক আক্রমণ করলেও লাভ হয়নি। রিয়ালের রক্ষণভাগকে পরাস্ত করতে পারেনি। সেই সাথে শেষ বাঁশি বাঁজার সঙ্গে সঙ্গে সেমি ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে রিয়াল মাদ্রিদ।
এবার নিয়ে গত ১২ বছরে ১০ম বারের মতো সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে বিশ্বের সেরা এই ক্লাব। চেলসির লিখা কামব্যাকের রূপকথাকে মাটির নিচে পিষে ফেলে মড্রিচ, বেনজেমারা। রিয়াল মাদ্রিদ তাদের রাজত্ব, তাদের আভিজাত্য বজায় রাখে। পাঁ ফসকানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও ব্যাক করে উচলের সেরা এই ক্লাবটি। ম্যাচটা দেখলে আপনার মনে হবে, চেলসির সাথে অন্যায় হয়েছে। চেলসি বেটার খেলেছে। সেমিতে চেলসিরই যাওয়া উচিত ছিলো। আপনার কথায় তো খাদ নেই। অবশ্যই গতকাল চেলসি অনেক ভালো ছিলো। কিন্তু ম্যাচটা দুই লেগের। এক লেগ দিয়ে ফলাফল বিবেচনা করলে হবে না। গতকাল চেলসি যতটা না ভালো ছিলো, তার চেয়ে বেশি রিয়াল মাদ্রিদ ভালো ছিলো প্রথম লেগে। ডিজার্ভ টিম হিসেবেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে রিয়াল মাদ্রিদ। সবশেষে স্প্যানিশ ভাষায় একটা কথা-ই বলতে মন চাচ্ছে। ‘Asi gana el Madrid’! যার অর্থ ‘রিয়াল মাদ্রিদ এভাবেই জিতে যায়’।