রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষক হয়ে উঠতে সময় লাগে একথা অকপটে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতা পনের বছরের হলেও সচেতনভাবে রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা ২১ বছর পেরিয়ে গেছে। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা থেকেই হোক কিংবা দলীয় কর্মী হিসেবে অভিজ্ঞতা থেকেই হোক, কিছু কথা বলি।
রাজনীতি তে পদ পদবি প্রাপ্তি ও অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা এখন বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এদেশের মানুষের পর্যবেক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ধরণ আমূল বদলে গেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য, রাজনৈতিক দলের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, দেশের জন্য রাজনীতি করা লোকের সংখ্যা কমতে কমতে ভীতিকর পর্যায়ে চলে এসেছে। সবথেকে ভীতিকর বিষয় হলো ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে লোকেদের চেহারা বদল, খোলস বদল ও চরিত্র বদল হয়ে যাচ্ছে । সবাই সরকারি দলে থাকতে চায়। বিরোধী রাজনীতিতে বড়ই অনীহা। আসলে বাস্তবতা হলো সরকারি দলের সাথে জুড়ে, মন্ত্রী, এমপির আশে পাশে ঘুরে সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে ভাল থাকা গেলে ডানবাম ফিরে তাকানোর কি দরকার? এমন মনোবৃত্তিসম্পন্ন লোকেদের আধিপত্য সর্বত্র বিরাজমান। তারা কিন্তু এমনি এমনি সুযোগ সুবিধা পেয়ে যান সেটা বলা যাবে না। তাদেরও বিরাট ত্যাগ আছে। তারা নেতার সাথে নিয়মিত সেলফি তোলেন, নেতার ছবি প্রশংসা আর স্তুতি বাক্য সমেত নিয়মিত ফেসবুকে পোস্ট করেন, বাপ – মায়ের উপরে, মাথার উপরে, সম্ভব হলে সাক্ষাৎ দেবতার আসনে বসাতেও কুন্ঠা বোধ করেন না। নেতার আশেপাশে বেশি ভীড় হলে নেতার গাড়িকেও সালাম দেন। গাড়ি উত্তর দিতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করে দেখা হয়নি অবশ্য। যাই হোক মৌচাকের আশেপাশে সক্রিয় মৌমাছির মত নেতার আশেপাশে নেতার প্রশংসার গুনগুন করা সুবিধাবাদীদের কাউকে নেতার মনে ধরলে তিনি হয়ে ওঠেন সফল মৌয়াল। সরকারি দলের নেতার আশীর্বাদ পাওয়া গেলে পীরের দরবারে যেতে হয় না, ইচ্ছা পূরণে মানত করতে হয় না।
নেতাই হলেন বড়পীর। বড়পীরের ছায়া পেলে সূর্যালোকের মুখ না দেখলেও চলে। নেতা যদি নজরানা গ্রহণ করেন তাহলে তো কথাই নেই তিনি হয়ে যেতে পারেন সাক্ষাৎ পীরের মুরিদ। নেতা খুশি হলে, পীরের মুরিদ হলে কেল্লাফতে। আর কি চাই? টাকা – পয়সা, ধন -দৌলত, গাড়ি – বাড়ি, শুরা- নারী সবই হাতের মুঠোয়। রাজপথ -ফুটপাত, সদর – অন্দর সবই দখলে। সবকিছু চলে ঈশারায়। সমঝদার কে লিয়ে ঈশারাই কাফি। পায়ে হাটার ফুটপাত হয়ে উঠে হকার্স অভয়ারণ্য ; অন্দরমহল হয় শুরামহল, রমনীয় ফূর্তিমহল। এগুলোর অবশ্য আধুনিক নাম টাম ও বেশ চমকপ্রদ। স্পা সার্ভিস, হোম সার্ভিস, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সড়কে জমে উঠে বিরাট গরু-ছাগলের হাট। নদীর তীরে আলোর ঝলকানিতে রং ছড়ায় বিলাসি বোট ক্লাব। রাজধানীর অদূরে গড়ে উঠে প্রমোদ রিসোর্ট। অবশ্য সবসময় দেশেই ফূর্তি করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, দুবাই, লন্ডন, নিউইয়র্কে আসা যাওয়া না করলে অভিজাত শ্রেনিতে নাম টা মলিন হয়ে যায় কি না! এই অভিজাত শ্রেণিতে নাম লেখানোর প্রতিযোগিতায় নামের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষণীয় বহিঃপ্রকাশ। আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেই পারি।
এর বাইরেও কথা থেকে যায়। সবাই কি নেতার আশীর্বাদ পায়? সবাই কি পীরের মুরিদ হতে পারে? স্বভাবতই পারেনা। পীর- মুরিদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বায়াতগ্রহনকারী শিষ্যদের নিরন্তর ধৈর্যের পরীক্ষা চলে। কেউ কেউ ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেয়। অবশেষে কলবের লাইন খুঁজে পায়। প্রকারন্তরে সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যায় বহুজন। নতুন আমদানিও হয়। দরগাহ থাকে জমজমাট। সময়ের পরিক্রমায়, জীবনের বাস্তবতায় যারা হারিয়ে যায় তারা হয়ে ওঠে এক একজন দার্শনিক। তবে পরিতাপের বিষয় হলো তাদের দর্শন প্রকাশের অবকাশ খুব বেশি থাকে না। ততদিনে কর্মজীবন সায়ান্হে, ধর্ম জীবনের ডাক পড়ে যায়। তখন উপরওয়ালার সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা ছাড়া তাদের আর বিকল্প থাকেনা। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে অমুক ভাই, তমুক ভাই আমাদের কাজে আসে নাই। ভাই দিয়ে কাম নাই। পীরের দরবার খালি নাই। দিনশেষে তারা ঘরে ফিরেও নিগৃহীত হয় কেননা জীবনের মূল্যবান সময়টা তারা যেখানে ব্যয় করেছে, সে সময় তাদের জীবন থেকে অমূল্য অনেক কিছু কেড়ে নেয়। তাদের মধ্যে যে আত্ম- উপলব্ধি ও জীবন দর্শন তা নীরবে – নিভৃতে চোখের পানিতে প্রকাশিত হয়। এ দর্শন কারো কাছে প্রকাশ করা যায় না, পাছে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা অভিমান তাকে গৃহবন্দী করে দেয়, সমাজ – রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনেই যেন মুক্তি। তবে প্রকৃতির নিয়মে দিবা- রাত্রির পালাবদলের ন্যয় ক্ষমতারও পালাবদল হয়, পীরের দরবারেও ভাটা পড়ে। ক্ষমতার আতিশয্যে প্রকৃত শিষ্যদের অনেকেই বঞ্চিত হলেও তখন তাদের কদর বাড়ে। সুবিধাভোগীরা নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করে নিজের দরগাহ রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকে। সুযোগ পেলে অন্য পীরের মুরিদ হয়ে যায়।
বাস্তবতা হলো এদেশেের রাজনীতি বাধ্য না হলে এখন আর কেউ দলের জন্য দেশের জন্য ঝুঁকি গ্রহণে আগ্রহী হয় না। সরকারি দলে এখন দুধের মাছির আনাগোনা এত বেশি যে নেতার পক্ষে প্রকৃত কর্মী চেনা কঠিন। প্রকৃত কর্মীরা চাটুকারিতার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকলেও প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নেয়। জহুরি যেমন হীরা চিনে তেমনি প্রকৃত নেতাও তার প্রকৃত কর্মী চিনতে পারেন। নিজের প্রকৃত অনুসারীদের যথার্থ মূল্যায়ন না করতে পারা, সঠিকভাবে না চিনতে পারা দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। যখন তা প্রকট হয়ে ওঠে, দুঃসময় সন্নিকটে চলে আসে। কিন্তু সবাই উপলব্ধি করে না। পরিতাপের বিষয় হলো রাজনীতিতে পুঁজিতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের আধিক্য ও আধিপত্য এতটা বেড়েছে যে রাজনীতিকে আদর্শিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার যে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রবাহ সেটা সরু নালায় পরিণত হওয়ার পথে।
লেখকঃ সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা