তুরস্কের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের নেতৃত্বের কারণে এতদিন লাইমটাইটে আসতে পারেননি বিরোধী নেতা কামাল কিলিকদারোগ্লু। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এবার তার সময় এসেছে নিজেকে তুরস্ককের পরবর্তী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। সেই সঙ্গে দেশটিকে একটি নতুন পথে দাঁড় করানোর সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে তার সামনে। দুই দশক ধরে তুরস্কের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অনুপস্থিতির অবসান ঘটানোর সুযোগও কিলিকদারোগ্লুর সামনে।
আগামী ১৪ মে তুরস্কে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন। ছয়টি বিরোধী দলের জোট ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কিলিকদারোগ্লু। নির্বাচনি প্রচারে সরগরম উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে তার। এ পর্যন্ত যতগুলো জরিপ পরিচালিত হয়েছে, তার বেশিরভাগ জরিপে ৭৪ বছর বয়সি কিলিকদারোগ্লুকে এগিয়ে কিংবা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের মুদ্রা লিরার ব্যাপক পতন হয়েছে। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া দীর্ঘ দুই দশক ক্ষমতায় থাকায় এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অভিযোগ আনা হয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণসহ বিরোধী মত দমনের অভিযোগও করা হচ্ছিল এরদোগান প্রশাসনের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো তো কাছা ছেড়ে এর বিরুদ্ধে প্রচার প্রপাগান্ডা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
রয়টার্স বলছে, নানা অভিযোগের মধ্যেই ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ভূমিকম্প ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এরদোগান সরকারের ওপর। শতাব্দীর ভয়াবহ ওই ভূমিকম্পে দেশটির ১১টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক লাখ ভবন। প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ভবন তৈরিতে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। তাছাড়া ভূমিকম্পের পর বেশ কিছু এলাকায় সময় মতো উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে না পারায় এরদোগানের ওপর ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ। অথচ এসব এলাকা ছিল ক্ষমতাসীন একে পার্টির ঘাঁটি।
তুরস্কের এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের একটা বড় অংশ নতুন ভোটার। যারা নির্বাচনের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বলে মনে করা হচ্ছে। জন্মের পর থেকেই শুধু এরদোগানের শাসন দেখে আসছেন এসব ভোটার। স্বাভাবিক কারণে তারা এখন নতুন নেতৃত্ব, নতুন শাসক দেখতে চান। তাছাড়া পুরনো ভোটারদের মধ্যেও অনেকে এবার নতুন কাউকে ক্ষমতায় দেখতে চান।
এসব কারণে বিরোধী নেতা কিলিকদারোগ্লুর পাল্লা তুলনামূলক ভারি বলে মনে করা হচ্ছে। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের রেখে যাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ দল সিএইচপির বর্তমান নেতা কিলিকদারোগ্লু। সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চিন্তাধারার পরিবর্তন বা কৌশল চেঞ্জ।
অর্থাৎ যে কামাল আতাতুর্কের সময় তুরস্কে আজান পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তার রেখে যাওয়া দল সিএইচপির ক্ষমতায় আসা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন তুরস্কের সাধারণ মুসলমানরা। তাই সাধারণ ভোটারদের একটা বড় অংশ গেছে এরদোগানের ঝুলিতে। তবে এবারের নির্বাচনে সেই অবস্থান পরিষ্কার করেছে সিএইচপি।
জোটে থাকা অন্য দলগুলোর সঙ্গে মতামতের ভিত্তিতে সিএইচপি ইসলাম বিরোধিতা থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছে দলটি, যদি তারা ক্ষমতায় যেতে পারে। তবে বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, কিলিকদারোগ্লু ক্ষমতায় গেলেই তা বোঝা যাবে।
এরদোগানের জনপ্রিয়তায় ধস নামার আরও একটি কারণ হলো ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সে ইসলামপন্থিদের অংশগ্রহণ। অর্থাৎ এক সময় এরদোগানের সঙ্গী এবং সরকারের অংশ ছিলেন- এমন অনেক নেতাও নতুন দল গঠন করে ছয় দলীয় জোটে যোগ দিয়েছেন। ফলে সিএইচপির ইসলাম বিরোধিতার যে ঐতিহ্য, দলটি সেখান থেকে সরে এসেছে বলে মনে করছেন সাধারণ মুসলমানরা।
অপরদিকে কিলিকদারোগ্লু গোঁড়া অর্থনৈতিক নীতি এবং সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ভিন্নমত দমন না করা, মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি পশ্চিমাদের সঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে বিরোধী জোট। এ নিয়ে খোদ প্রেসিডেন্ট এরদোগান সমালোচনা করে বলেছেন, ‘তাদের নাটাই সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে’।
ডেইলি সাবাহ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি এক নির্বাচনি সমাবেশে তুর্কি নেতা বলেছেন, তারা (বিরোধীরা) তাদের প্রভুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তুরস্ককে এমন একটি গর্তে ফেলতে যাচ্ছে, যেখান থেকে আগামী ৫০ বছরে দেশকে বের করে আনা সম্ভব হবে না। তুরস্ক তথা তার সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করায় পশ্চিমা গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনাও করেছেন এরদোগান।
তুরস্ক-ভিত্তিক লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিরল বাস্কান বলছেন, কিলিকদারোগ্লু এরদোগানের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরেছেন, যিনি একজন মেরুকরণকারী ব্যক্তিত্ব এবং যোদ্ধা যিনি… তার ভোটারের ভিত্তিকে সুসংহত করেছেন।
তিনি আরও বলছেন, কিলিকদারোগ্লুকে অনেক বেশি রাষ্ট্রনায়কের মতো মনে হচ্ছে। যারা তাদের জন্য ভোট দিচ্ছে না, তাদের কাছেই পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন জোটের নেতারা…এটাই তার (কিলিকদারোগ্লু) জাদু।
‘আমি নিশ্চিত নই যে তিনি (কিলিকদারোগ্লু) জিতবেন, কিন্তু তিনি সঠিক সময়ে সঠিক চরিত্রে হাজির হয়েছেন,’ বলছেন বিরল বাস্কান।