নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফ্রান্সের উচ্চপর্যায়ের একটি সামরিক সূত্র জানিয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার বাহিনী খুব দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে না। কিন্তু এ অবস্থার ভিত্তিতে তাদের এখনই ব্যর্থ বলা যায় না। যুদ্ধের কোনো একপর্যায়ে তারা পুনরায় সংগঠিত আক্রমণে যেতে সক্ষম হতে পারে।
রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রার গতিকে এখন পর্যন্ত ইউক্রেন কীভাবে আটকে রাখতে সক্ষম হলো, তার পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
প্রস্তুতি
২০১৪ সালে রাশিয়া ‘ঝটিকা’ অভিযানের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ কেড়ে নেয়। সে সময় রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ ঘটনার পর পশ্চিমাদের সহায়তায় ইউক্রেন তার সশস্ত্র বাহিনীকে যথেষ্ট শক্তিশালী করতে থাকে।
২০১৬ সালে ন্যাটো ও কিয়েভ ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীর জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করে। ইউক্রেনের এই বিশেষ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় ২ হাজার। এই বাহিনী এখন যুদ্ধের ক্ষেত্রে দেশটির বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকদেরও সহায়তা করতে পারছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ডগলাস লন্ডন বলেন, রাশিয়ার দখলদারি প্রতিরোধের জন্য ইউক্রেনীয়রা গত আট বছর পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও নিজেদের সুসজ্জিত করার কাজে ব্যয় করেছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক এই কর্মকর্তা ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যুদ্ধক্ষেত্রে কিয়েভকে উদ্ধারে এগিয়ে না–ও আসতে পারে, এ বিষয়টি বুঝে ইউক্রেন মস্কোকে কীভাবে ঘায়েল করা যায়, তার দখলদারিকে কীভাবে অচল করে দেওয়া যায়, সেসব কৌশলের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে।
স্থানীয় জ্ঞান
ইউক্রেন একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সেই সোভিয়েত আমলের জানা-শোনা-বোঝার ওপর নির্ভর করে ইউক্রেনে যুদ্ধে গেছে মস্কো। তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীর ঘরের মাঠের সুবিধার দিকটিকে অবমূল্যায়ন করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
ইউক্রেনে হামলা চালালে কী কী ভূখণ্ডগত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে, রাশিয়ার সে সম্পর্কিত হিসেবে রাশিয়ার ভুল আছে। আবার আক্রমণকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ার সক্ষমতা সম্পর্কেও রাশিয়ার চিন্তাভাবনায় ভুল লক্ষণীয়।
অনিয়মিত যুদ্ধের এমন পরিস্থিতিতে কোনো দুর্বল বাহিনী তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে স্থানীয় সুবিধাগুলোর সর্বাধিক সুফল নিতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স কলেজের অধ্যাপক স্পেন্সার মেরেডিথ বলেন, রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বাহিনী ভূখণ্ডগত সুবিধা, স্থানীয় জ্ঞান ও সামাজিক সংযোগের সুফল পাচ্ছে।
রুশ বাহিনী যখন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের মতো শহরগুলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাইবে, তখন শহুরে লড়াই শুরু হলে মস্কোর জন্য চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে।
ফরাসি সামরিক সূত্রের ভাষ্য, এ বিষয়টিই সবকিছু পরিবর্তন করে দেয়। রুশ বাহিনী রাস্তার প্রতিটি কোণে, ভবনে ভবনে সমস্যায় পড়বে।
সংহতি
রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। নিজের জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি রাজধানী কিয়েভে রয়ে গেছেন। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তিনি ইউক্রেনবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। ইউক্রেনের এই সাধারণ নাগরিকেরা স্বেচ্ছায় দেশ রক্ষায় যুদ্ধ করে চলছেন।
ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের নানা চিত্র অনলাইনে আসছে। তাঁরা একে-৪৭ রাইফেল চালাচ্ছেন, মলোটোভ ককটেল বানাচ্ছেন কিংবা সড়কে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলছেন।
অবসরপ্রাপ্ত ফরাসি কর্নেল মিশেল গোয়া বলেন, আঞ্চলিক সেনাদের দ্রুত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি হালকা অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা ছাড়া ইউক্রেনের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।
কৌশলগত ভুল
সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেনে হামলার প্রথম দিকে রাশিয়া কৌশলগত ভুল করেছিল। তারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইউক্রেনে খুব কমসংখ্যক স্থলসেনা পাঠিয়েছিল। রুশ স্থল ও বিমানবাহিনী একসঙ্গে কাজ করতেও ব্যর্থ হয়েছিল।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই মস্কো সামরিক সাফল্য অর্জন করবে বলে প্রথমে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধ এখন প্রায় দুই সপ্তাহে গড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইজসের রাশিয়া স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক মাইকেল কফম্যান বলেন, শুরুতে রাশিয়া ভেবেছিল, তারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে খুব দ্রুত রুশ ইউনিট সক্রিয় করতে পারবে। কিন্তু অচিরেই তারা ধাক্কা খায়।
মাইকেল কফম্যান বলেন, ‘অনুমানগুলো হাস্যকর ছিল।…আপনি কীভাবে তিন দিনের মধ্যে কিয়েভের দখল নেবেন? রাশিয়ার সামরিক বাহিনী এখন পরিস্থিতির সঙ্গে সমন্বয় করছে। এটিকে তারা সম্মিলিত সশস্ত্র অভিযান হিসেবে পরিচালনা করার চেষ্টা করছে।’
মনস্তাত্ত্বিক কারণ
হামলা শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে ইউক্রেন সীমান্তে লাখো সেনা মোতায়েন করে বিশ্বজুড়ে বিপদের ঘণ্টা বাজায় রাশিয়া।
কিন্তু ইউক্রেন সীমান্তে মোতায়েন করা রুশ সেনাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকেরই ধারণা ছিল যে প্রতিবেশী দেশে তাঁদের যুদ্ধে পাঠানো হবে। ইউক্রেনে যুদ্ধে গিয়ে অনেক রুশ সেনা হতাহত হয়েছেন। রাশিয়ার ধারণার চেয়ে এই সংখ্যা বেশি।
কিয়েভের দাবি, ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর এখন পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের এই দাবি যাচাই করা যায়নি। তবে এ বিষয়ে রাশিয়ারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রুশ সেনাদের ব্যাপক হতাহতের বিষয়টি তাদের মনোবলের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। ফরাসি সূত্র অনুসারে, এ পরিস্থিতিতে রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক কর্তাব্যক্তিরা যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো টম পেপিনস্কি বলেন, এখন পর্যন্ত যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তা ইঙ্গিত করছে যে রুশ যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে ইউক্রেনের আচরণ আরও কঠোর হতে পারে।
টম পেপিনস্কি বলেন, ‘ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ সবচেয়ে কার্যকর হবে, যদি রাশিয়ানরা চাপে পড়ে যায়, নিদ্রাহীন থাকতে হয়, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াপ্রবণ হয়।’ – কার্টেসিঃ প্রথম আলো