১৫০০ খ্রিস্টাব্দের কোন এক ভোর। জানা পৃথিবীর একেবারে পশ্চিমের শেষ দেশের শেষ গ্রামের এক বাসিন্দা কৌতুহলবশত তার নৌকোটাকে পশ্চিম অভিমুখে চালিত করলেন, যে দিকে যাবার সাহস করেনি আর কেউ।সারাদিন একঘেয়ে দাড় টানার পর হঠাৎ তিনি দেখলেন সামনের পথ শেষ। শেষ মানে শেষ। সামনে আর কিছুই নেই।আর খানিকটা এগুলেই হারিয়ে যেতে হবে অতল কোন গহব্বরে।অর্থাৎ ভদ্রলোক পৌঁছে গেছেন পৃথিবীর শেষ সীমানায়।আর তাতেই প্রমাণিত হয়ে গেলো যে, এই সুন্দর পৃথিবীটা আসলে চাকতির মত।ইতিহাসের পাতায় উঠে গেল তার নাম।
কেমন হতো যদি এমনটাই হতো ইতিহাস? কিন্তু না ইতিহাস এমন হয়নি, হয়েছে তার উল্টো। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দেই পিথাগোরাস মতপ্রকাশ করেছিলেন যে আমাদের পৃথিবী গোলাকার।আর ৫০০ থেকে ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মাঝামাঝি সময়ে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়া দেখে আনাক্সাগোরাস নিশ্চিত হলেন যে পৃথিবী গোলাকার। এরও প্রায় আড়াইশ বছর পর আরেক ভদ্রলোক ইরাটোস্থিনিস তো প্রায় নির্ভুলভাবে পৃথিবীর পরিধিই বের করে ফেললেন। কিন্তু সাদা চোখে দেখা এই পৃথিবীকে তো সমতলই মনে হয়।কোন স্বর্গীয় সুমিষ্ট ফলের স্বাদের বর্ণনা যতই শুনি না কেনো, তা মুখে পুরে না দেখা পর্যন্ত তার স্বাদ আস্বাদন করা হয় কি?
তাই পৃথিবী যে গোল তার তো একটা হাতে কলমে প্রমাণ চাই।সেরকম একটা অসাধ্য সাধন করেছিলেন ফার্দিনান্ড মাগেল্লান আর হুয়ান সেবাসাস্টিয়ান এলকানো।৩৬২৩৩ মাইল পথ সাগর পাড়ি দিয়ে ১৫২২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর যখন হুয়ান সেবাস্টিয়ান এলকানো ২৭ মণ লবঙ্গ আর দারুচিনি নিয়ে স্পেনে পৌছালেন তখন অতিবাহিত হয়ে গেছে তিনটি বছর।স্পেনিশ রাজা চার্লস-১ এর অর্থায়নে এবং মাগেল্লান এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই নৌ অভিযানের আসল উদ্দেশ্য ছিল মশলার দ্বীপে (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার Maluku Island বা Moluccas Island) এ যাবার একটি পশ্চিমমুখী রুট আবিষ্কার করা।১৫১৯ সালের ২০ এ সেপ্টেম্বর মাগেল্লান যখন স্পেনের সেভিলা Seville শহর থেকে যাত্রা আরম্ভ করেন তখন তার সাথে ছিল পাঁচটি জাহাজ আর ২৭০ জন আরোহী।মাগেল্লান আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে (বর্তমান নাম ম্যাজেলান প্রণালী,আটলান্টিক মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে)প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে পরেন।প্রশান্ত মহাসাগরও তার দেয়া নাম।
আর এটাই ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে চলা মানবসৃষ্ট প্রথম নৌযান। এরপর তিনি সোজা পশ্চিম অভিমুখে চলে পৌছে যান ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জে। অভিযান চলাকালে তাদের মুখোমুখি হতে হয় বিদ্রোহ,ক্ষুধা,স্কার্ভি,ঝড়-ঝঞ্ঝা আর স্থানীয়দের সাথে কলহ-বিবাদের।বিদ্রোহ দমনের জন্য করতে হয় বিচার আর শাস্তি হিসেবে দিতে হয় মৃত্যুদন্ড।ফিলিপিন দ্বীপে স্থানীয়দের সাথে এমনই এক যুদ্ধে প্রাণ দিতে হয় মাগেল্লানকে ১৫২১ সালে।এরপর অভিযানের নেতৃত্বে আসেন এলকানো।নানা পথ পরিক্রমায় ভারত মহাসাগর হয়ে আফ্রিকার উপকূল পাড়ি দিয়ে আবার আটলান্টিক হয়ে তারা যখন স্পেনে পৌছান তখন তাদের জীবিত সদস্যদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮ আর টিকে থাকা একমাত্র জাহাজটি ছিল ভিক্টোরিয়া।
যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এই অসীম সাহসী অভিযান পরিচালিত হয়েছিল তা ব্যর্থ হলেও এটাই হয়ে যায় মানুষের প্রথম বিশ্ব পরিভ্রমণ।আর আমাদের পৃথিবীটা যে আসলেই গোল তার একটা চাক্ষুষ প্রমাণ।
-উইকি অবলম্বনে