ভোগের নয়, কোরবানী হোক ত্যাগের উৎসব

  • প্রকাশিতঃ
  • ১৯ জুলাই, ২০২১ ১২:৫৬ অপরাহ্ণ

জুবায়ের আহমেদ:

পবিত্র ঈদুল আজহা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের ত্যাগের উৎসব। আরবী জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ই জিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানী করা মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। আগামী ২১শে জুলাই পবিত্র ঈদুল আজহা তথা কোরবানীর ঈদ। ত্যাগের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই কোরবানী করা হয়। সামর্থ্যবান মুসলিমরা পশু কোরবানী দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালন পালন করা নিয়ম হলেও ত্যাগের কোরবানী এখন লোক দেখানো এবং ভোগে পরিণত হয়েছে। কোরবানীর মাংসের সুষম বন্টন না করা, ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে হাট থেকে কোরবানীর পশু কিনে আনা সহ নানা প্রকার নিয়ম বিরোধী কাজ হচ্ছে কোরবানীর সময়। কোরবানী মুসলিমদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়, আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পশু কোরবানী দেওয়া হলেও কোরবানীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়া সহ মনের পশুর হিংস্রতা কমছে না বরং বাড়ছে দিন দিন।

আমাদের সমাজের সব মানুষের কোরবানী করার সামর্থ্য নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তারাই কোরবানী করছে। কোরবানীর একমাত্র উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা হলেও আজকাল কে কত বড় ও বেশি গরু কোরবানী করছে, কার গরুটা বেশি ভালো হয়েছে, কার গরুতে বেশি মাংস হয়েছে এসব নিয়ে আলোচনা চলে সমাজে। কারো কোরবানীর পশু ছোট হলে কিংবা দেখতে ভালো না হলেও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা হয়। কোরবানী নিয়ে সামর্থবানদের এই অমানবিক খেলার মাঝে যারা কোরবানী দিতে পারে না, তারা অসহায় হয়ে থাকে কোরবানীর সময়। সামর্থ্যবানদের কর্মকান্ডের ফলে অসামর্থ্যবানরা অপেক্ষা করতে থাকে কখন কোরবানীর রেশ শেষ হবে, তারাও অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের হাত থেকে রেহাই পাবে।

অসামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কোরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু কোরবানী আজকাল এতোটাই লোক দেখানো হয়ে গেছে যে, অসামর্থ্যবান কিংবা যতই ঋণগ্রস্থ হোক না কেনো কোরবানী না দিলে সমাজে কিংবা আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখানো কঠিন হয়ে যায়। ফলে কেউ কেউ ঋণের মাধ্যমে কোরবানী আদায় করে থাকেন লোক লজ্জার ভয়ে। আর কেউ যদি নিজেদের সমস্যার কারনে কোরবানী নাও দেয়, তারাও শান্তিতে থাকতে পারে না। কেনো কোরবানী দিচ্ছে না, কি সমস্যা, কষ্ট করে দিয়ে ফেললে কি হতো, এমন নানাবিধ মন্তব্যের তীর ছুড়ে প্রতিবেশীরা। এছাড়াও ত্যাগই যেখানে কোরবানীর শিক্ষা, সেখানে বড় বড় পশু কোরবানী দেওয়ার পর বছর জুড়ে নিজেদের মন্দ কাজগুলো বজায় রাখা এবং সাধারণ মানুষের কষ্ট না বুঝে ভোগ বিলাশে মত্ত থাকা কাম্য নয়।

কোরবানীর অর্থ হলো কাছে যাওয়া বা নৈকট্য অর্জন করা, ত্যাগ স্বীকার করা বা বিসর্জন দেওয়া। কিন্তু আমাদের কোরবানী হয়ে গেছে একেবারেই লোক দেখানো। কোরবানীর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না আমাদের সমাজে। আমরা ত্যাগের বিপরীতে ভোগ-বিলাসেই মত্ত হয়ে গেছি। ত্যাগ মানেই হলো কোরবানীর মাংস দরিদ্র প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের মাঝে কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্ধ ছাড়াই বিলি করে দেয়া। নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির লোভে পরে কৃপনতা না করে দরিদ্র প্রতিবেশী, দরিদ্র নিকটাত্মীয় ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহায়তা করা। কিন্তু আমরা ত্যাগে রাজী নই, ত্যাগেই যে প্রকৃত সুখ ও ¯্রষ্ঠার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, আমরা তা ভাবি না।

প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কোরবানী দেওয়া লোকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি দিন দিন মানুষের হিংস্রতা ও বর্বরতাও বাড়ছে বহুগুণে। খুন, ধর্ষণ, ব্যবসায়িক প্রতারণা, রাষ্ট্রীয় অর্থ পাচার, সরকারী পাওনা আদায় না করা, জেনা-ব্যভিচার, ঋণ খেলাপী হওয়া, অর্থ আত্মসাৎ সহ বহু অপরাধজনক কর্মকান্ড হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোরবানী যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তা আমরা বছর জুড়ে ব্যক্তি জীবনে প্রতিপালন করতে পারি না। শুধুমাত্র কোরবানীর সময় লক্ষ টাকা খরচে কোরবানী করেই জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ করে ফেলেছি মনে করি, যা ঠিক নয়। বছর জুড়ে আমরা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমেই কোরবানীর ত্যাগের শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে পারি, যা অন্তত জরুরী।

পবিত্র ঈদুল আজহা আসন্ন। বর্তমানে কোভিড ১৯ মহামারির কারনে দেশজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করলেও এ বছরও মানুষ পূর্বের ন্যায় কোরবানী করবে। যাদের সামর্থ্য নেই কিংবা যারা চলমান অচলাবস্থার কারনে অর্থনৈতিক সমস্যায় আছে, তারা এ বছর কোরবানী করতে পারবে না। তাই আমরা যারা কোরবানী করবো, আমাদের কোরবানী যেনো ভোগের না হয়, আমাদের কোরবানী যেনো হয় দরিদ্র অসহায় মানুষদের নিয়ে। যারা কোরবানী করতে পারবে না, তাদের প্রতি যেনো আমরা তাচ্ছিল্য প্রকাশ না করি। এমন কোন মন্তব্য যেনো না করি, যাতে তারা কষ্ট পায়, নিজেদের অসহায় মনে করে হতাশ না হয়। আমরা যারা কোরবানী করবো, আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই যেনো হয় মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন, আর এই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেনো আমরা কোরবানী নিয়ে সকল কার্যকলাপে সংযত আচরণ করি। কোরবানীর ত্যাগের শিক্ষা বছর জুড়ে বাস্তবায়ন করি। ভোগে নয়, ত্যাগেই সুখ, ত্যাগেই মনুষত্বের পরিচয় মেলে। আমরা যেনো এ চিরন্তন সত্যটি ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারি।

শিক্ষার্থী,
ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম,
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)।
কাটাবন, ঢাকা।

  • এম. রাশিদুজ্জামান

    লেখক ও গবেষক

    Related Posts

    • এপ্রিল ১০, ২০২৩
    • 88 views
    সন্তানের বটবৃক্ষ | মোঃ আরিফ হাসান

    বাবা ও মা পৃথিবীতে সন্তানের জন্য ছায়াদায়ক বটবৃক্ষের মতো,বাবা মা সবসময় তাদের সন্তানদেরকে নিঃস্বার্থ ভাবে আদর স্নেহ ভালোবাসার ছায়া দিয়ে রাখেন। তাই চলার…

    Read more

    • জুলাই ১১, ২০২১
    • 39 views
    লকডাউনে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

    চীনের উহান প্রদেশ থেকে ২০১৯ সালে ছড়ানো খোলা চোখে দেখা যায় না, এমন একটি ভাইরাসের কাছে অসহায় পৃথিবী, বিপর্যস্ত অর্থনীতি। দীর্ঘ প্রায় ২…

    Read more

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    You Missed

    দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে ড. ইউনূস সরকার

    দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে ড. ইউনূস সরকার

    সংবাদ সম্মেলন করে ১০ দফা দাবি সাদপন্থিদের

    সংবাদ সম্মেলন করে ১০ দফা দাবি সাদপন্থিদের

    এক্সপ্রেসওয়েতে দুই গাড়ির সংঘর্ষ, নিহত ১

    এক্সপ্রেসওয়েতে দুই গাড়ির সংঘর্ষ, নিহত ১

    দক্ষিণ আফ্রিকাকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ফেলে পাকিস্তানের ইতিহাস

    দক্ষিণ আফ্রিকাকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ফেলে পাকিস্তানের ইতিহাস

    বিসিএস তথ্য ক্যাডারের বঞ্চিতদের মানববন্ধন আজ

    বিসিএস তথ্য ক্যাডারের বঞ্চিতদের মানববন্ধন আজ

    বিকেলে চালু হচ্ছে মোবাইল ইন্টারনেট

    বিকেলে চালু হচ্ছে মোবাইল ইন্টারনেট