পহেলা বৈশাখ, চারুকলা, শাহবাগ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূল, ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত, এসো হে বৈশাখ, বর্ষবরণ, পান্তা-ইলিশ, বৈশাখি শাড়ি-পাঞ্জাবি— এইসব শব্দ শুনলেই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর এই যে পৌনঃপুনিক পশ্চাৎপ্রদাহ; সামান্য তলিয়ে দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়— এর পেছনে ধর্মীয় কোনো কারণ নেই; কারণ যা যা আছে, এর পুরোটাই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক মানে রাজনৈতিক, শতভাগই রাজনৈতিক; বর্ষবরণবিদ্বেষের পেছনে ধর্মের এক শতাংশ ভূমিকাও নেই। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বায়ান্ন বছর ধরেই (১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু) রাজনৈতিকভাবে পরাজিত। রাজনীতির খেলায় জিততে গিয়ে যখনই তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে, ঝুলি থেকে তখনই বের করেছে সেই অমোঘ ও অব্যর্থ অস্ত্র— ধর্ম। রাজনীতির মাঠে হেরে গিয়ে এই গোষ্ঠীটি প্রত্যেকবারই চেষ্টা করেছে ‘হারাম’ ফতোয়া দিয়ে, পুরো ব্যাপারটাকে ধর্মীয় আচ্ছাদনে মুড়িয়ে, ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের ভাবাবেগকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করে, বছরের পর বছর ধরে অক্লান্তভাবে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে একটা স্নায়ুযুদ্ধ জারি রাখতে এবং মগজধোলাইপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পূর্বতন রাজনৈতিক পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে। বলতে দ্বিধা নেই— উল্লিখিত গোষ্ঠীটি প্রত্যেক দফায়ই সফল হয়েছে।
বাংলা বর্ষবরণ যাদের কাছে হারাম; ব্যাপারটা এমন নয় যে, কেবল ‘বাংলা বর্ষবরণ’ই তাদের কাছে হারাম। তাদের এই হারামীকরণপ্রক্রিয়া মোটেই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং অত্যন্ত পূর্বপরিকল্পিত ও নিরবচ্ছিন্ন। এই একই চক্রের কাছে— শহিদমিনারে ফুল দেওয়া, জাতীয় সংগীত গাওয়া, শিখা চিরন্তন প্রজ্বলন হারাম; শেখ মুজিবুর রহমানের মুরাল, জাহানারা ইমামের ভাস্কর্য, বাউল ফকিরদের গান হারাম; পোশাক কারখানায় নারীশ্রমিক, বিচারালয়ে নারী বিচারপতি, সংসদে নারীনেতৃত্ব হারাম। এদের কাছে, কিছুকাল যাবৎ ‘হিন্দুয়ানি’ অভিযোগে খোদ বাংলা ভাষাও ছিল হারাম। একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষাকরণ, বাংলা কথাবার্তা আরবি-ফারসি হরফে লিখন, বাংলা ভাষায় অপ্রয়োজনীয় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের আগ্রাসন— ইত্যাকার হেন কৌশল নেই, বাংলা ভাষার খতনা করার জন্য যা এই গোষ্ঠীটা অবলম্বন করেনি। অর্থাৎ চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্ত সত্তার ওপরই ধর্মীয় বিষবাষ্প ছিটিয়ে দিয়ে উগ্রবাদী সম্প্রদায়গুলো চেষ্টা করেছে বাঙালিকে বাঙালিয়ানা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, বাঙালি মুসলমানকে ‘পাকিস্তানি মুসলমান’ বানানোর অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অন্তত ‘আরব মুসলমান’ বানাতে, শস্য-শ্যামল সবুজ বাংলাকে মরুভূমির রূপ দিতে।
বৈশাখি মেলা, পুতুলনাচ, হালখাতা ইত্যাকার লোক-আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেওয়ার ইতিহাস শত-শত বছরের পুরোনো। এই ইতিহাসের সাথে অবশ্য রাজনীতির সংশ্লেষ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, এর সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে অর্থনীতির। কিন্তু ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে পহেলা বৈশাখের উদযাপন হয়েছে; তা ছিল রাজনৈতিক, ঘোরতর রাজনৈতিক। তখন এ দেশের মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবীরা পহেলা বৈশাখকে ব্যবহার করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র প্রতিবাদের প্রকৃষ্ট অস্ত্র হিশেবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচারের পাশাপাশি তৎকালীন শাসকচক্র বাঙালিদের ওপর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও কতটা দমন-পীড়ন চালিয়েছিল; এর ফিরিস্তি, আশা করি, এই নিবন্ধে উপস্থাপন করতে হবে না। তা নিয়ে বরং পিএইচডির জন্য আলাদা অভিসন্দর্ভ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— তৎকালে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, সরকারি গণমাধ্যমে কোনো ধরনের রবীন্দ্রসংগীত বাজানো তখন নিষিদ্ধ ছিল, ব্যক্তিপর্যায়েও রবীন্দ্রচর্চা ছিল দুরূহ। কাজী নজরুল ইসলামের সেসব গানই বাজানো হতো, যেগুলো ‘হিন্দুয়ানি না’ কিংবা ‘কম হিন্দুয়ানি’। কথিত ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ সরিয়ে, যেমন ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’ বাক্যকে ‘সজীব করিব গোরস্তান’ বানিয়ে, তৎকালে নজরুলের গানের মুসলমানি করা হয়েছে। আইয়ুব খানদের আমলে কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম বদলে রাখা হয়েছিল ফাতেমাচূড়া, ময়মনসিংহকে করা হয়েছিল মোমেনশাহী, সিলেটকে জালালাবাদ। বাংলা বাক্য আরবি-ফারসি কিংবা উর্দু হরফে লেখার প্রস্তাব দেওয়ার মতো অকল্পনীয় ধৃষ্টতাও ঐ আমলে দেখানো হয়েছে।
১৯৬১ সাল ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন তখন অত সহজ কম্ম ছিল না। বিচারপতি মাহবুব মুর্শেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীদের নেতৃত্বে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সেই পরিস্থিতিতেও রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন করেছিলেন এবং এই অপরাধে শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে, মুক্তিযুদ্ধকালে হত্যা করে গোবিন্দ চন্দ্র ও মোফাজ্জল হায়দারকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের সেই অপরাধের শাস্তিও দিয়েছিল। একষট্টি সালের রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপন হয়ে উঠেছিল একাত্তর সালে তাদের মৃত্যুর কারণ। অর্থাৎ সামরিক শাসকদের রবীন্দ্রভীতি আর বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্রপ্রীতি কোনো মামুলি ব্যাপার বা ছেলেখেলা ছিল না, ছিল এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের সূচনাপর্ব। এই রবীন্দ্রনাথের গানই প্রাক-একাত্তরকালে স্বাধীনতাকামী জনতাকে উদ্বেলিত করেছে, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উজ্জীবিত করেছে, একাত্তর-পরবর্তীকালে যুগিয়েছে স্বৈরাচারপতনের মন্ত্রণা।
একষট্টি-পরবর্তীকালে সনজীদা খাতুনদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট, যার সদস্য ছিলেন মূলত একষট্টিতে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদযাপনের আয়োজকরা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালের পহেলা বৈশাখ ভোরে রমনা উদ্যানের অশ্বত্থ গাছের পাদদেশে ছায়ানটের জনা বিশেক শিল্পী বসে পড়েছিলেন সেরেফ গান গাওয়ার জন্য। মূলত রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল সেই সংগীতায়োজনের উপজীব্য। ও রকম গুমোট পরিস্থিতিতে বন্দুকের নলের মুখে রবীন্দ্রনাথকে উপজীব্য করে প্রকাশ্যে গান গাইতে বসা, উপর্যুপরি বাংলা গান গাইতে থাকা, উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই সহজ কোনো কাজ ছিল না। তখন সেরেফ এ রকম একটা সংগীতায়োজনই ছিল বিশাল রাজনৈতিক প্রতিবাদ। সম্ভবত ১৯৬৭ সালেই পহেলা বৈশাখকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহারের সূত্রপাত হয় এবং এই হাতিয়ার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকদের বিপক্ষে, এই হাতিয়ার ছিল বাংলার স্বাধিকার আদায়ের পক্ষে, এই হাতিয়ার ছিল বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক-সামরিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। একাত্তরের যুদ্ধ নিছক সামরিক ছিল না। যুদ্ধ পর্যন্ত পৌঁছতে, অর্থাৎ যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হতে যে সাংস্কৃতিক ধাপগুলো ছিল; এদের মধ্যে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপনও ছিল অন্যতম। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ‘পহেলা বৈশাখ’ ছিল বছরের অন্য তিনশো চৌষট্টি দিনের মতো সাধারণ একটি দিন, ১৯৬৭ থেকে ‘পহেলা বৈশাখ’ হয়ে গেছে রাজনৈতিকভাবে মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি দিবস।
আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও মুক্তিকামী মানুষ পহেলা বৈশাখকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করেছিল। স্বৈরশাসনের কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন দুরূহ হয়ে উঠেছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যখন খর্ব হচ্ছিল, এরশাদের আনুগত্য প্রকাশ ব্যতীত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালন যখন প্রায় অসম্ভব ছিল; ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকে যশোরের সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ অরাজনৈতিক ব্যানারে তখন পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা বের করা শুরু করেছিলেন। সেই শোভাযাত্রার কোনো আনুষ্ঠানিক নাম ছিল না। কেউ বলতেন আনন্দ শোভাযাত্রা, কেউ বৈশাখি শোভাযাত্রা। যশোরের হাত ধরে সেই শোভাযাত্রা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল দেশজুড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বৈশাখি শোভাযাত্রা বের হওয়া শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালে। এরশাদের পতন কামনাই ছিল মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন তৎকালীন শিল্পী-সাহিত্যিকদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য।
কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী কখনও কোনো সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলেনি। কেননা সামরিক শাসকদের আমলেই ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো সর্বাধিক সুবিধা, আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আশকারা পেয়ে থাকে। অনির্বাচিত সামরিক বা বেসামরিক সরকারগুলো তটস্থ থাকে একমাত্র ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কাছে, সাধারণ জনগণের কাছে অনির্বাচিত শাসকদের জবাবদিহির প্রয়োজন পড়ে না। ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামি লিগ সরকার উগ্রবাদীদের কাছে এখনকার মতো নতজানু ছিল না, কেননা সেই সরকার ২০১৮-এর মতো রাতের আঁধারে নির্বাচিত ছিল না। ক্ষমতায় থাকাকালে এরশাদ ধর্মীয় গোষ্ঠীর মন জয় করে ফেলেছিলেন মাত্র একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে— রাষ্ট্রধর্ম প্রণয়ন। যে শাসক রাষ্ট্রধর্ম প্রণয়ন করেছেন, সেই শাসকের বিরুদ্ধে পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারটা ধর্মীয় গোষ্ঠীর পছন্দ হওয়ার কথা না। তা ছাড়া, এই শোভাযাত্রার আয়োজক যারা কিংবা শোভাযাত্রার সর্বাগ্রে যারা থাকতেন; তারা ষাটের দশকেও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন করেছেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধও সংগঠিত করেছেন, আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিককার ঐতিহাসিক গণআদালতও বসিয়েছেন। বৈশাখি শোভাযাত্রার আয়োজকরা যেখানে ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রকাশ্য, পুরোনো ও চিহ্নিত শত্রু; সেখানে গোটা শোভাযাত্রাই যে ‘হারাম’ হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোনো কিছুকে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে মৌলবাদীরা রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত বা পরাজিত করতে যখনই ব্যর্থ হয়েছে; তখনই ধর্মকে বাজারে তুলেছে, হারামতত্ত্ব হাজির করেছে, একে-ওকে মুরতাদ খেতাব দিয়ে জীবন বিপন্ন করেছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছে আরো একবার— ২০১৩ সালে। যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে দানা বেঁধে ওঠা গণজাগরণ স্থায়ী হয়েছিল বেশ কয়েক মাস। ঐ বছরের মঙ্গল শোভাযাত্রার থিম ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদেরকে ভয়ংকর রূপে ফুটিয়ে তোলা বিদ্রুপাত্মক পুত্তলিকা হাতে নিয়ে সে-বার পহেলা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রা সংঘটিত হয়েছিল। অতীতেরও কিছু-কিছু মঙ্গল শোভাযাত্রায় যুদ্ধাপরাধীদের পুত্তলিকা বহন করা হলেও ব্যাপক আকারে ২০১৩ সালেই মঙ্গল শোভাযাত্রা যুদ্ধাপরাধীময় ছিল। অর্থাৎ চারুকলা বা রমনাকেন্দ্রিক পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদ্দেশ্য ১৯৬৭ সালেও রাজনৈতিক ছিল, ১৯৮৯ সালেও রাজনৈতিক ছিল, রাজনৈতিক ছিল ২০১৩ সালেও; যে রাজনীতির বিপক্ষশক্তি এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, যে গোষ্ঠীটা ‘হারাম’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের বুক থেকে বাংলা বর্ষবরণকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। বাংলা বর্ষবরণ নিশ্চিহ্নকরণের এই অবিরাম অপচেষ্টা তারা পঞ্চান্ন বছর ধরেই করে চলছে। বাংলা ভাষা কিংবা বাংলাদেশকেই যারা অদ্যাবধি মেনে নিতে পারেনি, তারা বাংলা নববর্ষকেও যে মেনে নেবে না, জন্মের শত্রুতা পোষণ করে ‘হারাম’ আখ্যা দিয়ে মানুষের মন বৈশাখের ব্যাপারে বিষিয়ে তুলবে— সেটিই স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নিয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তির উচ্চিংড়ে উত্তরসূরিদের এই আকণ্ঠ আক্রোশ আর আপাদমস্তক আস্ফালন, সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হয়েছে মাত্র ১৯৯৬ সালে। সেরেফ সারা দেশের মঙ্গল কামনা করার উদ্দেশ্যে এই সম্মিলিত পদযাত্রা। পদযাত্রাকালে যাত্রীদের হাতে বিভিন্ন প্রাণীর ছোট-বড় কিছু পুতুল বা মুখোশ থাকে। ব্যাপারটা এমন না যে, হাতির পুতুলের কাছে নতজানু হয়ে কেউ পরীক্ষায় ভালো ফল করার ব্যাপারে তদবির করে। এমনও না যে, প্যাঁচার পুতুলের কাছে হাতজোড় করে বিবাহিত কেউ বলে— আমার পারিবারিক অশান্তি দূর করে দাও। আবার এমনও না যে, বাঘের পুতুলের কাছে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে অবিবাহিত কেউ বলে— আমাকে আমার মনের মতো স্বামী এনে দাও। মঙ্গল শোভাযাত্রায় কোনো পুতুলকে কেউ পূজা করে না, পুতুলের দরবারে মোনাজাত ধরে না, পুতুলের উদ্দেশে কেউ ভক্তিগীতিও পরিবেশন করে না। মিছিলের সময়ে হাতে কিছু-একটা থাকলে উৎসব-উৎসব আবহটা বেশি অনুভূত হয় বলেই মঙ্গল শোভাযাত্রায় এই পুতুলের উপস্থিতি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় পুতুলের কাছে প্রার্থনা করা হয় না বিধায় এখানে ‘শেরেক’ প্রশ্নও আসে না। এই পুতুলকে পুঁজি করে ‘শেরেক’ আখ্যা দিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে কিংবা গোটা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ধর্মবিরোধী সাব্যস্ত করার পেছনে ‘ধর্ম’ নেই, আছে দুরভিসন্ধিমূলক রাজনীতি। ১৯৬৭ সালে রাজনৈতিকভাবে পহেলা বৈশাখ পালনের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এর প্রতিশোধস্বরূপ তাদের বংশধররাই এখন চাইছে ধর্মকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করে গণমানুষকে বৈশাখ-বিমুখ করতে। এদের কেউ-কেউ বলে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি আমদানির ভারতীয় চক্রান্ত’, অথচ এরা জানেই না— বাংলাদেশে ১৯৮৪ বা ১৯৯৬ সালে শুরু হলেও কোলকাতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে মাত্রই ২০১৭ সালে। বরং ভারতের উগ্র হিন্দুরা যদি বলত— মঙ্গল শোভাযাত্রা ভারতে বাংলাদেশী সংস্কৃতি আমদানির চক্রান্ত, তা হলে সেটিই বেশি যৌক্তিক শোনাত।
মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে কেউ ধর্মবিরোধী কোনো বাক্য উচ্চারণ করেনি, শোভাযাত্রা শেষে কেউ কোনো উপাসনালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়নি, নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের অনুসারীদের বাড়িঘর লুটপাট করেনি। পহেলা বৈশাখকে যারা নাজায়েজ হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, মাহফিলে-মাহফিলে যুগ-যুগ ধরে বিষোদগার চালিয়েও তারা সুবিধে করে উঠতে পারেনি; বরং বৈশাখের আয়োজনগুলোয় জনসমাগম প্রতিবছর উত্তরোত্তর বেড়েছেই। ছায়ানটের বর্ষবরণ উদযাপন শুরুর চৌত্রিশ বছরের মাথায়, ২০০১ সালের পহেলা বৈশাখে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি রমনা বটমূলের সংগীতানুষ্ঠানে বোমাহামলা চালায়; যা কেড়ে নিয়েছিল নয়জনের প্রাণ, যাবজ্জীবন পঙ্গু করে দিয়েছিল আরো অনেককে। এমন নারকীয় ঘটনার পরও মানুষকে ওরা বৈশাখ-বিমুখ করতে পারেনি, রমনা বটমূল থেকে দূরে সরাতে পারেনি, পারেনি মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে।
গণহত্যার পরও মানুষ যখন বৈশাখ-বিমুখ হলো না, তখন উগ্রবাদী চক্রটি অবলম্বন করল ভিন্ন আরেকটি বীভৎস কৌশল— পহেলা বৈশাখে আগত নারীদের ওপর সংঘবদ্ধ যৌন হামলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘবদ্ধ হয়ে ভুভুজেলা বাজিয়ে উচ্চশব্দ সৃষ্টি করে মনুষ্যবৃত্ত তৈরি করে সেই বৃত্তের মধ্যে নারীদেরকে ঢুকিয়ে ২০১৫ সালে যৌন নির্যাতন করেছে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের একটা অংশ। বিভিন্ন টেলিভিশনের সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল এই চাঞ্চল্যকর দুরভিসন্ধি। যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ-লক্ষ মানুষকে হত্যা করেও একটা জাতির মনোবল ভেঙে দেওয়া যায় না। মনোবল ভেঙে দেওয়া যায় সেই জাতির নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়ে। বৈশাখ উদযাপনের ওপর সাধারণ মানুষের বিতৃষ্ণা সৃষ্টির জন্য মৌলবাদীরা ‘যৌন নির্যাতন পদ্ধতি’ অবলম্বন করতেও বাকি রাখেনি। মুখে ‘শান্তি’র ফেনা তুললেও অশান্তি সৃষ্টির তাবৎ উপায় এই গোষ্ঠীটি জানে এবং বাস্তবায়ন করে। রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য এরা ওয়াজ মাহফিলে স্বাধীনভাবে বিষবাষ্প ছড়াবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাধাহীনভাবে কুৎসা রটাবে, সব উপায় ব্যর্থ হলে নরহত্যা সংঘটিত করবে; অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য সম্ভাব্য সমস্ত উপায় অবলম্বনের ‘অধিকার’ তাদের আছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ ঘরের ভেতরে বসেও টুঁ শব্দটি করলে তাদের বিভিন্ন অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে, রক্ত টগবগ করবে; ফলশ্রুতিতে টুঁ-শব্দ উচ্চারণকারীর ভবলীলা সেখানেই সাঙ্গ হবে।
‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’ গোষ্ঠীর বৈশাখবিরোধিতার কারণ যে ধর্মীয় না, রাজনৈতিক— এর সপক্ষে আরো একটা প্রমাণ আছে। ২০০০ সালে কোটালিপাড়ার জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রেখে আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টার ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বোমাহামলার ঘটনায় মামলা হয় যাদের বিরুদ্ধে এবং যারা ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামি লিগের সমাবেশে গ্রেনেডহামলা মামলার আসামি— সামান্য মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেই ধরা পড়ে যে, এই তিন মামলায় কয়েকজন ‘কমন’ আসামি আছে; অর্থাৎ এই ঘটনায়ই হামলা বাস্তবায়নকারীরা একই ব্যক্তিবর্গ এবং তিন হামলার নির্দেশও এসেছিল মোটামুটি একই ‘কর্তৃপক্ষ’ থেকে। ২০০০ ও ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যাপ্রচেষ্টার ঘটনা যেহেতু নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক, একই হামলাকারীদের দ্বারা সংঘটিত ২০০১ সালে রমনা বটমূলের হত্যাকাণ্ডও সেহেতু সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। রমনা বটমূলে বোমাহামলায় ধর্ম ছিল না, ছিল রাজনীতি। অতএব পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে হারাম আখ্যা দেওয়া মোল্লা-মৌলভিরাও ঐ রাজনৈতিক গোষ্ঠীটিরই ডাণ্ডাবরদার মাত্র।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরোধিতা তখনই করা যেত— যদি এই উদযাপনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলক করা হতো, যদি আদালত থেকে হুকুম আসত পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ না খেলে নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে, যদি সংসদ আইন পাশ করত— পহেলা বৈশাখে লাল-শাদা পোশাক না পরলে আড়াই বছরের সশস্ত্র কারাদণ্ড হবে, যদি ছায়ানট হুমকি দিত— নব্বই শতাংশ সেকুলারের দেশে বৈশাখ-বিরোধীদের ঠাঁই হবে না, যদি ‘চারুল উলুম’ (চারুকলা অনুষদ) থেকে ফতোয়া আসত— মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ না-করা ব্যক্তিবর্গ জাহান্নামি জাহান্নামি জাহান্নামি। এ রকম হুমকিধামকি কখনোই আসেনি, আসবেও না। পহেলা বৈশাখ উদযাপন, শহিদমিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শিখা অনির্বাণ প্রজ্বলন— কেউ কারো ওপর চাপিয়ে তো দেয়ইনি, দেবেও না কখনও। তবুও পহেলা বৈশাখ কিংবা শহিদমিনার নিয়ে মোল্লা গংয়ের গাত্রদাহের অন্ত নেই। পঞ্চান্ন বছর যাবৎ বিরতিহীন বিষোদগার, নারকীয় বোমাহামলা, অনবরত হারাম-হারাম-হারাম সাব্যস্তকরণ, অভ্যাগত নারীদের ওপর যৌন সন্ত্রাস, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি— ইত্যাকার কারণে পহেলা বৈশাখের আনন্দ আয়োজনে লোকসমাগম এখন আর আগের মতো হয় না, এ কথা অনস্বীকার্য। লোকজন যা-ও আসেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা এর চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ পুলিশ দিয়ে চারদিক থেকে পরিবেষ্টিত থাকে। এই পুলিশবেষ্টনী নিয়েও মোল্লা গং ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে ছাড়ে না। অথচ মোল্লা গং ভুলে যায়— তাদেরই বোমার কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আজ শোভাযাত্রার যাত্রীদের চেয়ে পুলিশ বেশি। নিজেরা আদর্শিক প্রতিপক্ষের একাধারে প্রাণহানিও ঘটাবে, আবার প্রতিপক্ষের সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাস্বল্পতা নিয়েও তামাশা করবে— অসভ্যতার এর চেয়ে নির্লজ্জ নজির আর কিছু হতে পারে না।
মৌলভিদের কাছে প্রথম-প্রথম সবকিছুই হারাম, নাজায়েজ, বেদাত থাকে। শুরুর দিকে যেকোনো আবিষ্কারেরই বিরোধিতা করাকে তারা ঐশী দায়িত্ব বলে মনে করে থাকেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বাংলাদেশী মোল্লারা কী এলোমেলো আচরণ করেছিলেন, তা কারোই ভোলার কথা না। তারা জোর গলায় বলেছেন মুসলমানদের করোনা হবে না, আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করোনাভাইরাসের নেই, হুমকির ভঙ্গিতে বলেছেন করোনার জন্যে মুসলমানরা মাস্ক পরতে পারবে না। অথচ করোনা সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, এ নিয়ে মোল্লাগোষ্ঠীর এমন উদ্ভট আচরণের কোনোই প্রয়োজন ছিল না। মোল্লাদের চোখে এককালে ইংরেজি হারাম ভাষা ছিল; এখন ওয়াজ মাহফিলে সেইসব মোল্লার হাদিয়াই বেশি, যেসব মোল্লা ওয়াজে সবচেয়ে শুদ্ধ করে ইংরেজি বলতে পারে। রেডিও-টেলিভিশন মাত্র দেড়-দুই যুগ আগ পর্যন্তও হারাম ছিল। মোল্লারা যখনই টকশো করার সুযোগ পেয়ে কিছু হাদিয়া পকেটস্থ করার সুযোগ পেয়ে গেলেন, এর পর থেকেই রেডিও-টেলিভিশন হালাল হয়ে গেল। অথচ মাত্রই কয়েক বছর আগে ঢাকার রাস্তার দেয়ালে-দেয়ালে লেখা ছিল, ‘যেসব মওলানা টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে করে, তারা ওলামায়ে ছু— মাসিক আল বাইয়্যিনাত।’
ফেসবুক-ইউটিউবে যখন মওলানাদের আনাগোনা ছিল না বা কম ছিল, তখন ফেসবুক-ইউটিউবও হারাম ছিল। এখন ইউটিউবারদের মধ্যে মওলানাদের উপার্জনই যখন সবচেয়ে বেশি, তখন ফেসবুক-ইউটিউবও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালাল হয়ে গেছে। এমনকি মাইকও এককালে হারাম না যেন বেদাত ছিল। যে যন্ত্র খোদাপ্রদত্ত মনুষ্যকণ্ঠকে বর্ধিত করে, সেই যন্ত্র ব্যবহার করা খোদার শক্তির সাথে শেরেকি— এই ছিল মাইকবিরোধী মোল্লাদের যুক্তি। মাইকের আওয়াজকে তারা এমনকি ‘শয়তানের আওয়াজ’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। এর পর মাইক যখন ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হলো, তখন থেকেই মাইক জায়েজ হয়ে গেল। এখন মাইক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ওয়াজ মাহফিলেই। অর্থাৎ যেসব যন্ত্রপাতি ও উৎসব থেকে বাংলাদেশের মওলানাদের আয়-ইনকামের ব্যবস্থা নেই, সেসব প্রথমদিকে হারাম থাকে; আয়ের ব্যবস্থা হলেই সবকিছু হালাল তো হয়ই, বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ খুঁজে বের করে চোখে আঙুল দিয়ে মওলানারা দেখিয়েও দেন— একসময়ে এ রকম আবিষ্কার যে হবে, সে ব্যাপারে অনেক আগেই শাস্ত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে; বিজ্ঞানীরা আসলে শাস্ত্রীয় কেতাব থেকেই ধারণা ধার করে বা চুরি করে এই আবিষ্কার করেছেন, বিজ্ঞানীরা আসলে মওলানাদেরই ছাত্র অথবা চোর।
মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজকরা একটু বুদ্ধি খাটালেই শোভাযাত্রা হালাল হয়ে যেত। এজন্য যা করতে হতো, তা হচ্ছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে মওলানাদের একাংশকে সম্পৃক্ত করা। পহেলা বৈশাখ থেকেও যদি কিছু উপরি আয়ের ব্যবস্থা থাকত, তবে বহু আগেই পহেলা বৈশাখ পালন জায়েজ হতো। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যদি রমনা উদ্যানেরই অন্য কোনো গাছের নিচে সীমিত আকারে ওরস শরিফের আয়োজন হতো, চারুকলার বকুলতলায় অন্তত ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছোটখাটো একটা ওয়াজ মাহফিলের ব্যবস্থা থাকত, যদি বৈশাখের প্রথম সাতদিন দেশের মহল্লায়-মহল্লায় আয়োজিত হতো মিলাদ শরিফ, ইলিশের বৃহত্তম টুকরোটা যদি তুলে দেওয়া হতো মিলাদে পৌরোহিত্য করা হুজুরের পাতে, ইলিশ কোটা-বাছার জন্য যদি দাওয়াত করে নিয়ে আসা হতো লিল্লাহ বোর্ডিং-এতিমখানার ছেলেদেরকে, পিরসাহেবদের বাড়ি-বাড়ি যদি পৌঁছে যেত সরষে ইলিশ আর ইলিশের মালাইকারি; অর্থাৎ ‘অর্থনীতি’ যোগ হয়ে গেলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন পির-হুজুরদের চোখেও হালাল তো হয়ে যেতই, শোভাযাত্রায় বহন করা হাতি-ঘোড়া বাঘ-ভালুক প্যাঁচা-শালিকও হালাল হয়ে যেত, সেইসাথে মিলাদ-মাহফিল থেকে বজ্রকণ্ঠ বুলন্দ আওয়াজ আসত— সাড়ে নিরানব্বই শতাংশ বাঙালির দেশে পহেলা বৈশাখের অবমাননা বরদাশত করা হবে না, বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার ইজ্জত রক্ষা করব; ছায়ানট নিয়ে কেউ একটা কটাক্ষ করলে এই বাংলার জমিনে তার জায়গা হবে না, জায়গা হবে না, জায়গা হবে না।
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানমালা কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। কেয়ামতের আগ পর্যন্ত এই জিনিশ চলবে বা চালিয়ে যেতে হবে, এমনটা নয়; এ রকম কোনো ঘোষণাও শোভাযাত্রার আয়োজকরা দেননি। আবেদন ফুরিয়ে গেলে শোভাযাত্রা এমনিতেই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। বোমাহামলা চালিয়েও যখন বন্ধ করা যায়নি, তখন কিছুতেই এই আনন্দযজ্ঞ আর বন্ধ করা যাবে না; কেননা বৈশাখের আয়োজন রঙে-রঙে রঙিন, বর্ণে-বর্ণে বর্ণাঢ্য। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই রঙপ্রিয় ও রঙ্গপ্রিয়। বৈশাখবিরোধী যারা, তাদের হাতে কোনো রঙিন উৎসব নেই। তাদের উদযাপিত সব উপলক্ষই রঙহীন, বিবর্ণ, শাদা-কালো; সেসব আয়োজনে আবার সব ধর্মের সব বন্ধুকে নিয়ে অবাধে অংশগ্রহণেরও সুযোগ নেই। পহেলা বৈশাখে সব ধর্মের সব লিঙ্গের সব বিশ্বাসের সবাইকে নিয়ে সোল্লাশে অংশগ্রহণ করা যায় বলেই ন্যূনতম বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালি পহেলা বৈশাখকে লুফে নিয়েছে। যে বাঙালি সকালে পহেলা বৈশাখ পালন করে; (মুসলমান হলে) সেই বাঙালিই দুপুরে নামাজ আদায় করতে পারে, (হিন্দু হলে) সন্ধ্যায় পূজা করতে পারে, (খ্রিষ্টান হলে) রাতে গির্জায় যেতে পারে। পহেলা বৈশাখের সাথে মসজিদ-মন্দির-গির্জার সংঘর্ষ বা শত্রুতা নেই। পহেলা বৈশাখের সাথে যাদের শত্রুতা; তাদের শত্রুতা ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। তাদের এই শত্রুতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
পহেলা বৈশাখের আনন্দ আয়োজন অচিরেই নির্মূল করা যাবে না। পহেলা বৈশাখের বিরোধী যারা আছেন, পহেলা বৈশাখকে নিশ্চিহ্ন করার বৃথা চেষ্টা না করে তারা ভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে পারেন; সেটি হলো পহেলা বৈশাখেরই সমান্তরালে এমন আরেকটি উৎসব প্রতিবছর আয়োজন করা— যেটি হবে পহেলা বৈশাখের চাইতেও বর্ণাঢ্য ও ব্যাপকবিস্তৃত, যেখানে অংশগ্রহণ করার জন্য সারাবছর ধরে মুখিয়ে থাকবে সব ধর্মের সব বিশ্বাসের লোকজন, সর্বজনীনতার মাপকাঠিতে যে আয়োজন সব দিক থেকে ছাড়িয়ে যাবে পহেলা বৈশাখ কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে। কোনো-কোনো হুজুরের কাছে একুশে বইমেলাও এককালে হারাম ছিল, একুশে বইমেলাবিরোধী বয়ান ওয়াজ মাহফিলগুলোয় নব্বইয়ের দশকে কম শোনা যায়নি। সেই বয়ান অবশ্য এখন আর শোনা যায় না। একুশে বইমেলায় এখন ধর্মীয় লেখকরাও বই প্রকাশ করছেন, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বইমেলায় এসে স্বাভাবিকভাবে ঘুরছেন-ফিরছেন, মেলা থেকে লাইভ ভিডিও সম্প্রচার করছেন। একুশে বইমেলায় এখন ধর্মীয় বইয়েরও একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে, যা বইমেলাকে প্রকৃতপক্ষে আগের চেয়েও আরো বেশি সর্বজনীন করে তুলেছে। বৈশাখবিরোধীরা যদি বইমেলারই মতো শান্তশিষ্টভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও অংশগ্রহণ শুরু করেন অথবা পহেলা বৈশাখের আদলে সর্বজন-অংশগ্রহণযোগ্য একটা উৎসবের আয়োজন করেন, তাতে মানসিক শান্তি বাড়বে বৈ কমবে না। তাতে তাদের জনসম্পৃক্ততাও আরো বাড়বে।
আমার বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ, আমি অন্যের আয়োজনে যাব না, আমার আয়োজনে অন্যকে আসতে দেবো না— এর নামই মৌলবাদ, একেই বলে উগ্রপন্থা, এই মানসিকতাই গোটা মানবজাতির জন্য ভয়ংকর রকমের ক্ষতিকর। কোনো ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠী বিশ্বের কোথাও একা চলতে পারে না। অন্যের আয়োজনে যদি না যাই বা নিজের আয়োজনে যদি অন্যেকে আসতে না দিই, এর প্রেক্ষিতে সেও যদি ঘোষণা দেয় তার আবিষ্কৃত কোনো প্রযুক্তি আমি ব্যবহার করতে পারব না; তা হলে আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বসে আমি আর বিপ্লব ঘটাতে পারব না (যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমার আবিষ্কৃত না), আমাকে চলে যেতে হবে সেই প্রস্তরযুগে, হাতে বল্লম নিয়ে আমাকে ছুটতে হবে পশুশিকারে। অবশ্য পশুশিকারে আমি বল্লমও নিতে পারব না, কেননা বল্লমও আমার আবিষ্কৃত না, বল্লমের পেটেন্টও অন্য কারো কিংবা অব্য কোনো সম্প্রদায়ের। আধুনিক জামানার কোনো আবিষ্কারেই যে সম্প্রদায়ের দূরতম কোনো ভূমিকা নেই, অন্য সম্প্রদায়কে দূরে রাখার বা অন্য সম্প্রদায় থেকে দূরে থাকার কোনো সুযোগই তাদের নেই। সবাইকে নিয়ে যারা চলতে চায় না, সবাইকে নিয়ে চলতে চাওয়াদেরকে যারা উলটো বাধা দেয়; তারা বড়জোর ‘ধার্মিক’, আর যা-ই হোক, তারা অন্তত ‘মানুষ’ না। ধার্মিকদের পৃথিবী কায়েমের চাইতে মানুষের পৃথিবী কায়েমের চেষ্টা বেশি জরুরি।
রাজনীতি মোকাবেলা করতে চাইলে মোকাবেলা করতে হবে রাজনীতি দিয়েই, ধর্ম দিয়ে নয়। রাজনীতি আর ধর্ম সমান শক্তিশালী নয়, ভীষণ রকমের অসম। রাজনীতির সাথে স্বার্থ জড়িত, ধর্মের সাথে আবেগ। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলে এর পরিণতি কী হয়, তা সবারই জানা। জেনেও না জানার ভান করলে তার পরিণতি কী হয়, তা-ও সবার জানা। এই উপমহাদেশকে ধ্বংস করেছে ধর্মীয় রাজনীতি আর রাজনৈতিক ধর্ম। ধর্মের আধ্যাত্মিক রূপটি এখন উধাও হয়ে আছে। রাজনৈতিক ধর্ম ও ধর্মীয় রাজনীতিকে ভদ্রভাবে বিদায় জানিয়ে আধ্যাত্মিক ধর্মকে ফিরিয়ে আনা, ধর্মকে রাজপথে না নামিয়ে উপাসনালয়ে সীমিত রাখা, ধর্মকে ইহলৌকিক কার্যসিদ্ধির কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার না করে পারলৌকিক মঙ্গলের উপায় হিশেবে আত্মস্থ করা এখন ভীষণ প্রয়োজন।
লেখক: আখতারুজ্জামান আজাদ
[email protected]
mobileservice provider AT T Inc and MetroPCS, which merged withT Mobile less than three months ago, target cost consciouscustomers who pay for calls in advance priligy dapoxetine amazon 1 PBS T for 1 h at RT donkey anti rabbit Alexa Fluor 488 1 500; donkey anti chicken Alexa Fluor 488 1 500; donkey anti rat Alexa Fluor 488 1 500; donkey anti rabbit Cy3 1 500 followed by washes in PBS and incubation of DAPI 1 5000, D9542 Sigma Aldrich dissolved in water for 30 min at RT
Sure, I ran, but only in short spurts and with the motivation of a 200 pound, mud slicked woman named Poppy growling behind me priligy uk