দিন একটাই। অথচ সেই দিনের মোহনায় অভিশাপ আর মুক্তি মিলেমিশে একাকার।
১৯৬৮ সালের ২৯ মে। এইদিন ‘বাসবি বেবিরা’ ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৪-১ গোলে হারিয়েছিল বেনফিকাকে। জর্জ বেস্ট গোল করেছিলেন। দুটি গোল করেছিলেন ববি চার্লটনও। ১০ বছর আগের মিউনিখ ট্র্যাজেডি থেকে বেঁচে যাওয়া চার্লটনই ছিলেন জয়ের নায়ক।
১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মিউনিখের আকাশে ছাই হয়ে গিয়েছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। বিমান দুর্ঘটনায় ক্লাব কর্মকর্তাসহ ২৩ জন নিহত হন। ২১ জন প্রাণে বেঁচে যান। যাদের একজন ছিলেন ম্যানেজার ম্যাট বাসবি। সেই বিমানে ছিলেন ববি চার্লটন এবং বিল ফুকেসও। দুর্ঘটনায় ম্যান ইউনাইটেড হারিয়েছিল ডানকান এডওয়ার্ড, এডি কোলম্যান এবং লিয়াম হেলানের মতো তারকাকে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ক্লাবটির এক দশক লেগেছিল। ম্যাট বাসবিই আবার ম্যানচেস্টারে ফুল ফুটিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে ওয়েম্বলিতে বেনফিকাকে হারানোর পর তিনি বলেন, ‘ছেলেরা আমাকে গর্বিত করেছে। আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা এটাই। আজ রাতে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে গর্বিত মানুষ আমি।’ ট্র্যাজেডির এক দশক পর প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল ইউনাইটেড। ছাই-ভস্ম থেকে ফুল হয়ে ফোঁটা ‘বাসবি বেবিরা’ যাদের হারিয়েছিল, সেই বেনফিকাতে তখন খেলতেন ইউসেবিও, কোলানা, তোরেস এবং আগুস্তোর মতো তারকারা।
বেনফিকা অবশ্য হারকে অভিশাপ মনে করেছিল। পর্তুগিজ ক্লাবটির কপালে সেই অভিশাপের কলঙ্ক কে দিয়েছিলেন জানেন? ১৯৬২ সালের ২ মে অভিশাপটা দিয়েছিলেন বেলা গাটম্যান। এক সময় লিসবনের ক্লাবটিতে কোচিং করাতেন এই বিখ্যাত ইহুদি ভদ্রলোক। তখন বেনফিকাতে খেলতেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ইউসেবিও। গাটম্যানের হাত ধরেই ১৯৬১ ও ১৯৬২-তে ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল বেনফিকা। এরপর আটবার ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল খেললেও কোনোদিন তারা জিততে পারেনি। লোকে বলে এই ব্যর্থতার পেছনে আছে গাটম্যানের অভিশাপ।
কেন নিজের ক্লাবকে অভিশাপ দিয়েছিলেন গাটম্যান? সেই গল্পটাই এবার শুনুন। ’৬২-এর ২ মে, আমস্টারডামের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ৫-৩ গোলে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল বেনফিকা। সেই ম্যাচে ইউসেবিও দুটি গোল করেন। রিয়ালের পক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন আরেক কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাস। ডি স্তেফানো গোল করতে পারেননি। প্রথমার্ধে ৩-২ গোলে এগিয়ে ছিল রিয়াল। প্রথম ৪৫ মিনিটেই হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিলেন পুসকাস। সবাই স্তেফানোর দলের জয় চেয়েছিলেন। না চাওয়ার কারণও ছিল না। বাষট্টির রিয়াল দলটা ছিল ক্লাব ইতিহাসের অন্যতম সেরা। পুসকাস-স্তেফানোর সঙ্গে ছিলেন লুইস ডেল সোল। অবশ্য বেনফিকাও খারাপ ছিল না। মারিও কোলানা তখন উদীয়মান। ইউসেবিও প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ার্ধের ৫০ মিনিটে কোলানার গোলে সমতায় ফেরে বেনফিকা। এরপর দুই গোল করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন ইউসেবিও।
শিরোপা নিয়ে লিসবনে ফেরেন গাটম্যান। ফিরেই কর্তৃপক্ষের কাছে ৬৫ শতাংশ বেতন বাড়ানোর দাবি জানান। কর্তৃপক্ষ সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে রেগেমেগে গাটম্যান বলেন, ‘পরের একশো বছরেও কোনোদিন বেনফিকা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হবে না।’ তার সেই অভিশাপ কিন্তু ফলতে শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান কাপ এখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ১৯৬২ সালের পর কেটে গেছে ৫৮ বছর। এই সময়ের মধ্যে ৮ বার ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলেছে বেনফিকা, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
গাটম্যান ছিলেন খুব বর্ণময়। হাঙ্গেরির ইহুদি পরিবারে জন্ম। হলোকস্টের সময় পরিবার ও বন্ধুরা নিহত হলেও তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। ফুটবলার হওয়ার আগে হতে চেয়েছিলেন ডান্সার। ১৮৯৯ সালে বুদাপেস্টে জন্ম নেওয়া গাটম্যান হাঙ্গেরি থেকে প্রথমে অস্ট্রিয়ায়, তারপর আমেরিকা হয়ে লিসবনে থিতু হন।
১৯৫৩ সালে এসি মিলানের কোচ হয়েছিলেন গাটম্যান। সেখানেও ক্লাব কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি। চাকরি ছাড়ার আগে বলেন, ‘গুডবাই এসি মিলান। আমি অপরাধী বা হোমসেক্সচুয়াল নই। তবু আমাকে বরখাস্ত করা হলো।’ ইতালি ছেড়ে পর্তুগালে এসে প্রথমে এফসি পোর্তোর ম্যানেজার হন গাটম্যান। জাতীয় লিগে পোর্তোকে চ্যাম্পিয়নও করেন। বেনফিকা তাকে প্রস্তাব দেয়। গ্রহণ করেন সেই প্রস্তাব। ম্যানেজার হিসেবে মোজাম্বিক থেকে তরুণ ইউসেবিওকে খুঁজে বেনফিকায় এনেছিলেন গাটম্যান। দলের তরুণদের তিনি বলতেন, ‘প্রতিপক্ষ গোল দিলে আমি কিছু মনে করি না কারণ বেশি গোল করার ক্ষমতা রাখে আমার দল।’
বেনফিকা ২০১৪ সালে সর্বশেষ ইউরোপিয়ান ফাইনাল খেলেছিল সেভিয়ার বিপক্ষে। টাইব্রেকে ৪-২-এ হেরেছিল লিসবনের ক্লাবটি। কোচ জর্জ জিসাস জনসমক্ষে বলেছিলেন, ‘গাটম্যানের অভিশাপ এখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি।