জাতিগতভাবে বাঙালীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে দেশের প্রসিদ্ধ দার্শনিকরাও কিছুটা স্তম্ভিত হয়েছেন। আহমদ সফা ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে বাঙালী মুসলমান সমন্ধে বলেন, “ইসলামও যে একটা উন্নততর দীপ্ত ধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সংসাধন করেছিলন, বাঙালী মুসলমানের মনে তার কোনো গভীরাশ্রয়ী প্রভাবও পড়েনি বললেই চলে।’’ হুমায়ুন আযাদ ‘বাঙালী: একটি রুগ্ন জাতি গোষ্ঠী?’ প্রবন্ধে বাঙালীদের একটি চরিত্র তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখায় বলা হচ্ছে, “ বাঙলায় এমন কোনো পিতা পাওয়া যাবে না, যিনি পুত্রকে সৎ হ’তে বলেন না; আর এমন পিতাও খুব কম পাওয়া যাবে, যিনি পুত্রের অসৎ উপার্জনে গৌরব বোধ করেন না।” এমন সবল দার্শনিকদের মতামতের কাছে আমার মত একজন নস্যির কাছে একটা বিষয় বারবার নাড়া দিয়েছে। স্বাভাবিক করণেই ঘন ঘন উপসনালয়ে যাওয়া হয় আবার বিভিন্ন দফতরেও বিভিন্ন কাজে যাওয়া হয়। এছাড়াও প্রতিনিয়ত আমি মানুষ দেখি। রাস্তায় দাড়িয়ে দেখি। পাবলিক বাসে দেখি। পার্কে বসে দেখি। দেখি মানুষের বৈচিত্র। মনোযোগ দিয়ে শুনি এবং বুঝার চেষ্টা করি তাদের কথা। সর্বোপরি বোধগম্য তথ্য থেকে একটা সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারি, যেটা হলো বাঙালী মুসলমানরা এবাদতে নিঃসন্দেহে সৎ। বাঙালীরা সাধারণত সঠিক সময়েই এবাদতের উদ্দেশ্যে উপাসনালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, সরকারী বা বেসরকারী অফিসের কর্মরত থাকেন তখন অবশ্যই এবাদতের নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই উপস্থিত থাকেন। নিয়মিত ধর্মীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। নিজেরাও আলোচনায় অংশ নেন। মানুষের জন্ম বা মৃত্যুতে প্রথাগত সকল নিয়ম যথাযথভাবে পালিত হতে দেখা যায়। দান সদকা, সময় হলেই হজ্ব গমন, ফি বৎসরে গরীবের মাঝে খাবার বিতরণ, শাড়ী বিতরণ, কম্বল বিতরণ করেন। ধর্মীয় কোন বিষয়ে সামান্যতম আঘাতের কথা শোনা মাত্র স্ফুলিঙ্গের মত ফুসে উঠে প্রতিবাদ করেন। এমনকি কখনও তা যাচাইও করার প্রয়োজন মনে করেন না।
কিন্তু গলতটা যেখানে দেখা যায় সেটি হলো কর্ম। নিজের দায়িত্বের কর্মগুলো সম্পন্ন করার বেলায় যত অভিযোগ। আর না হয় সব ঠিক ছিল। নিজের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো সম্পাদন করতে নানা অযুহাত খোঁজেন, অথবা সংক্ষিপ্তভাবে করে, আবার কখনও অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে পরের ধাপে চলে যাবার একটা ব্যপক প্রবনতা তাড়া করে বেড়ায়। বাঙালীরা কাজ যে পারেনা, বিষয়টা তা-না। শুধু দায়িত্বের কাজ ছাড়া আর বাকী সব কাজই পারে। আবার দায়িত্বের কাজটুকু করবেন, তথাপিও সেই কাজের বিনিময় আশা করে বসে থাকবেন। বিনিময় ছাড়া কোন কাজ করার রেওয়াজ এই বাংলায় গড়ে উঠেনি। তা সে যেকোন পর্যায়ের বাঙালীই হোন না কেন।
কথা হলো, মানুষের মৃত্যু অমোঘ। মৃত্যুর পর আরেকটা জীবন আমাদের সুনির্ধারিত। সেই জীবন সুখের হোক, শান্তির হোক তা আমরা সবাই চাই। চাই মানে কি, প্রবলভাবে চাই। পরবর্তী জীবন সুখের না দুখের তা অর্জনের জন্য দুটি ভিত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। একটি হলো ইবাদত আর অন্যটি দৈনন্দিন কর্ম। অধিকাংশ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় মুসলমানদের জীবনাচরণ সমন্ধেই আলোকপাত করা যাক। মুসলিম ধর্মানুসারে পাপকাজ করলে সে যাবে জাহান্নামে অর্থাৎ দুখের জীবন সে পাবে। এই পাপকাজগুলোকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটা পাপকাজ তখনই সংঘটিত হয় যখন অন্যের কোন অধিকারকে অন্যায়ভাবে লঙ্ঘন করা হয়। মানুষের উপর অধিকার দুই ধরনের। কিছু অধিকার রয়েছে যেগুলো মহান সৃষ্টিকর্তার সরাসরি। আবার কিছু অধিকার যেগুলো সৃষ্টিকর্তার নয়, বরং সৃষ্টের। এটাকে ধর্মীয় ভাষায় বলা হয়, হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল এবাদ। মুসলমানদের এবাদতের প্রতি সচেতনতা এবং তা পালন করা হলো আল্লাহর অধিকার। মা-শা-আল্লাহ, বাঙালী মুসলমানরা মহান সৃষ্টিকর্তার অধিকার যথেষ্ট ভালভাবেই পালন করে। তাহলে হক্কুল এবাদের জন্য কী হবে? পরকালে জাহান্নাম পাবে নাকি হুর পরি নিয়ে জান্নাতে অবস্থান করবে?
হক্কুল ইবাদ বলতে আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাদের অধিকার। সমাজে অবস্থানরত মানুষদের মাঝে পারস্পারিক নানাবিধ অধিকার স্থাপিত হয়। হয়ত সরকারী বেসরকারী অফিসে চাকুরী করার কারনে আপনার উপর কতিপয় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে অথবা সমাজে একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসেবেও কিছু দায়িত্ব স্কন্ধে বর্তায়। সেই বর্ণিত দায়িত্ব যখন আপনি পালন না করবেন, অবহেলা করবেন তখনই অন্যের অধিকার নষ্ট হয়। মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করার কারনের যে পাপ সাধিত হলো তার ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা হলো তিনি তা কখনো ক্ষমা করবেন না। হাদীছে বর্ণিত আছে, শহীদের সকল গোনাহ মাফ করা হবে, শুধু মানুষের অধিকার ব্যতীত।
সুনির্ধারিতভাবে কোন কাজগুলো মানুষের অধিকার তার একটা বর্ণনা থাকা দরকার। এটা হয়ত এই ছোট লেখনীতে বর্ণনা করা সম্ভব না হলেও কতিপয় উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করা হবে। যেমন আমি একটি অফিসে চাকুরী করি। সেখানে বলা আছে সকাল ন’টা থেকে বিকাল পাচঁটা পর্যন্ত কর্তব্যে থাকতে হবে। যদি কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া প্রতিনিয়ত দেরীতে অফিস গমন বা সময়ের পূর্বেই অফিস থেকে প্রস্থান করি, তাহলে অন্যকোন উপায়ে ঘুষ গ্রহণ না করলেও আমার চাকুরীর বেতন হালাল হবে না। এমনকি আমার অনুপস্থিতির সময়ে কোন গ্রাহক অপেক্ষা করে থাকলে তার অধিকার ক্ষুন্ন করার অপরাধে আমি অভিযুক্ত হবো। তেমনিভাবে আমি অফিসের উর্ধ্বতন কমকর্তা হয়ে যদি অধীনস্তদের সময়ের অধিক অফিসে থাকতে বাধ্য করি তবে সেটাও অধিকার ক্ষুন্ন করার অপরাধই হবে। একজনের চাকরী অন্যকে দেয়াও তেমনি একটি অপরাধ।
বিদ্যুৎ-পানি বা অন্যকোন পাবলিক দ্রব্য ব্যবহারেও খেয়াল রাখা জরুরী। কেননা অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যবহারেও আমরা অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন করে থাকি। অনেকে হয়ত বলবেন এসবের অতিরিক্ত ব্যবহার সেটা হক্কুল এবাদ নয়, আমি বলব যদি হক্কুল এবাদ নাও হয়, নিঃসন্দেহে সেগুলো অবচয়। রাসুল সাঃ বলেন, যদি তোমরা সাগরের তীরেও অযু করতে যাও, আর সেখানেও যদি প্রয়োজন অতিরিক্ত পানি ব্যবহার কর সেটাও অপচয় হিসেবেই গণ্য হবে। আর কোরআনুল মাজিদে বলা হয়েছে, ইন্নাল মুবাজ্জিরিনা কানু ইখওয়নুশ শায়াতিন। অর্থাৎ অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তানের ভাই হলে নিশ্চয় জান্নাতে হুর পরিদের সাথেই থাকবেন!
আমাদের কর্মে অসৎ হওয়ার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো রমজান এলেই সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়া। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের যে সিন্ডিকেট, তাদের অধিকাংশই, আমার জানা মতে, এবাদতে অনেক সৎ। তারা অভাবীদের ইফতার করায়, ত্রাণ দেয়, শাড়ি কাপড় দেয়, ওয়াক্তমত নামাজ আদায় করে, লম্বা কেরাতে তারাবিহ পড়ে। কিন্তু ব্যবসায় মানুষকে কষ্ট দেয়। মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করে। রাজধানীর প্রত্যেক রাস্তার ফুটপাতগুলো সাধারণ মানুষের অধিকারের। তারা এখানে যেন বিনা বাঁধায় হাটতে পারে সেজন্যই তৈরী। কিন্তু ফুটপাত বেদখল হয়ে আছে। তারা যত ভাল ব্যবসাই করুক, নিশ্চিতভাবে তারা মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করছে। মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। আব্দুল্লাহ বিন উমর ও জাবের বিন আবদুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুল সাঃ বলেছেন, মুসলিম তো সেই, যার জবান এবং হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ। আমরা আমাদের ভাইদের হাত থেকে কতটুকু নিরাপদ? সরকারী অফিসের কোন চাকুরেই হোক, পুলিশ হোক, সাংবাদিক হোক, কোন ব্যবসায়ী হোক, এমনকি ধর্মীয় গুরুদের হাত থেকেও নিরাপদ থাকা অনেক বেশী কষ্টসাধ্য। আমাদের সরকারী অফিসগুলোতে হাস্যরসাত্মকভাবে প্রচলিত আছে, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসদুপায়ের টাকা পাইতে দেরী হলে এমনও বলে থাকেন, “ভাই টাকাটা দিলে দেন, না হয় আমি আবার নামাজে চলে যাব।”
হক্কুল এবাদ নষ্ট করার সবচে কাছাকাছি থাকে জনপ্রতিনিধিরা। কেননা জনগণের অধিকারের অধিকাংশ আসে তাদের মাধ্যমে। জনগণের অধিকারের অংশ তাদের ব্যক্তিগত অংশের সাথে যদি বিন্দুমাত্র মিশে যায় আর সেটা সে বক্ষণ করে তাহলেও সে সৃষ্টের অধিকার নষ্ট করার দায়ে দায়ী হবেন। অন্যের অধিকার নষ্ট করার পাপ এত বড় পাপ যে, পাপী ব্যক্তি হাজার বার তওবা করার পরও ক্ষমা হবে না যতক্ষন না সেই ব্যক্তির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা হবে এবং সে স্বেচ্ছায় ক্ষমা করে দিবে। মানুষের অধিকার হরণ করে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াটা নিতান্ত প্রায়শ্চিত্তের কারণ। পরলৌকিক জাহান্নাম তো বটেই ইহলৌকিকভাবেও আত্মা শান্তিতে থাকতে পারে না। কারণ এধরণের সম্পদ অর্জন সামাজিকভাবে ইমব্যালেন্স তৈরী করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে প্রত্যেকেরই ব্যক্তি জীবন উন্মোচিত। অধিকার বঞ্চিতরা সম্পদ অর্জনকারী ভোগবিলাস আর তামাশা দেখে উগ্র হয়ে উঠে ও সমাজে সবার জীবন বিষিয়ে দিবে। অপর দিকে সম্পদ অর্জনকারীর আত্মাও শান্তি পাবে না। এই আত্মা হবে অতৃপ্ত আত্মা। অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে জীবন সায়াহ্নে যতই মসজিদ মাদ্রাসা বা উপসনালয় করুন না কেন কোন কাজে আসবে না। ঐশিবানী পাঠকারী হয়ত বাড়বে তাতে সমাজের গুণগত কোন পরিবর্তন আসবে না।
লেখকঃ এম রাশিদুজ্জামান, সহকারী গ্রন্থাগারিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার