ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই প্রায় পুরোটাই ছিল আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলন। স্বাধিকার আন্দোলনই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। ১৯৭০ থেকেই ছাত্ররা স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েছিল। তারা গোপনে নিজেদের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা পাকিস্তানকে বর্জন করার প্রতীক হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবে। এ লক্ষ্যে পতাকার একটি নকশা তৈরি করে ফেলে। সিদ্ধান্ত হয়, মূল ক্ষেত্রটি সবুজ বাংলাদেশের প্রতীক হিসাবে গাঢ় সবুজ রং হবে, তার মাঝখানে বিপ্লবের প্রতীক হয়ে থাকবে লাল সূর্য। সূর্যের মাঝখানে সোনালি বাংলাদেশের প্রতীক হিসাবে থাকবে সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র।
নিঃসন্দেহে ছাত্রদের এ পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন ছিল একটি দুঃসাহসিক কাজ। জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। স্বাধীনতার ঘোষণাও বলা যায়। পতাকাকে ফারসি ভাষায় বলা হয় নিশান। নিশান কথার শাব্দিক অর্থ ঘোষণাপত্র। সুলতানি যুগে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক কয়েকবার বাংলা আক্রমণ করেছিলেন।
প্রতিবারই আক্রমণের আগে জনমত নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য ‘নিশান’ জারি করতেন। অর্থাৎ, আক্রমণের যৌক্তিকতা দেখিয়ে ঘোষণাপত্র জারি করতেন। নিশান যখন পতাকা হিসাবে পরিচিত হলো, তার অর্থ পতাকাটি একটি ঘোষণার প্রতীক। এ ঘোষণাটি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা। সুতরাং এ কথা বলাই যায়, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ছাত্ররা পতাকা উত্তোলন করে বাংলার মানুষের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরির সঙ্গে রাজনীতিবিদ ও জঙ্গি হামলায় নিহত কাজী আরেফ আহমেদ যুক্ত ছিলেন। তার বক্তব্য থেকে পতাকা তৈরির আনুপূর্বিক দৃশ্যপট জানতে পারি। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, “১৯৭০ সালের ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়। ওইদিন ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয়, একটি ‘বাহিনী’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। এবারও ‘নিউক্লিয়াসের’ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর।
এ বাহিনীর নাম দেওয়া হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আ স ম আবদুর রবকে। ‘নিউক্লিয়াস’ থেকে বাহিনীর পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ পতাকা বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ’ হিসাবে প্রদান করা হবে। ৬ জুন ’৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই।
এ ফ্ল্যাগ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আ স ম আবদুর রব বলেন, এ পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাহজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি-বটলগ্রিন জমিনের ওপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এ নকশা ‘নিউক্লিয়াস’ হাইকমান্ডের অনুমোদন নেওয়া হয়।
তখন আমি প্রস্তাব করি, এ পতাকাকে পাকিস্তানি প্রতারণা থেকে বাঁচাতে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের মানচিত্র দেওয়া উচিত। কারণ হিসাবে দেখালাম, প্রায়ই বাংলাদেশের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘ভারতের হাত আছে’ বা ‘ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ হচ্ছে’ অথবা ‘ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ’ বলে প্রচারণা চালায়। তা ছাড়া এ সময় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’ বা ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’ নামের কাল্পনিক একটি দেশের জন্ম দেওয়া হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ও মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এ কল্পিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’-এর মানচিত্র তৈরি করে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্র তা বিলি করত। এ ধরনের প্রচারণা থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সোনালি আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র পতাকার লাল সূর্যের মাঝে রাখার আমার এ প্রস্তাবে সবাই একমত হন। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘পতাকা তৈরি’র এসব কাজ করা হয়।
পতাকার কাপড় কিনে তৈরি করতে পাঠানো হয় কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, মনিরুল হক, হাসানুল হক ইনু ও শহীদ নজরুল ইসলামকে। তারা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো নামক দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিংয়ের পাক ফ্যাশন থেকে তৈরি করায়। যে দর্জি এ পতাকা তৈরি করেন, তিনি ছিলেন অবাঙালি এবং ইতিবৃত্ত না জেনেই এ পতাকা তৈরি করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ওই দর্জি পাকিস্তানে চলে যান।
সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালি মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এ সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাশ (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নম্বর কক্ষে। তার কাছ থেকে এটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো বাংলাদেশের মানচিত্র।
সোনালি রং কিনে আনা হলো। শিবনারায়ণ দাশ ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালি রং। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্যদিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের ‘নতুন পতাকা’র জন্ম হলো।
রাতেই এ পতাকার সার্বিক অনুমোদনের জন্য ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক হয় ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। বৈঠকে পতাকাটি অনুমোদিত হলো। এবার বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনের কাজটি বাকি থাকল। রাজ্জাক ভাইয়ের ওপর দায়িত্ব পড়ে অনুমোদন আদায় করার। রাজ্জাক ভাই সেই রাতেই (৬ জুন) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুমোদন গ্রহণ করতে সক্ষম হন। তবে তাকে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি (বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র, কাজী আরেফ আহমেদ, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৭৭)।’
এভাবেই প্রস্তুত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। এ পতাকা তৈরির পর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দেওয়া হয়েছিল। যদিও আজ পতাকা দিবস। দিনটি ধরা হয়েছে এজন্য যে, ২ মার্চ ’৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় লক্ষাধিক লোকের সামনে ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’র সভায় আ স ম আবদুর রব কলাভবনের পশ্চিম প্রান্তের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পতাকাটি প্রদর্শন করেছিলেন।
এ পতাকাই পরদিন (৩ মার্চ) পল্টন ময়দানে শাহজাহান সিরাজের ‘স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ’-এর জনসভায় উত্তোলন করা হয়। ওই মঞ্চে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এ ইতিহাসটি ভুললে চলবে না, বাঙালি অনেক আগে থেকেই মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শাসকদের তথা পাকিস্তান থেকে। না হলে ১৯৭০ সালের জুন মাসে স্বাধীনতার পতাকা তৈরি হতো না।
ঠিক করা হয়েছিল ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে অভিবাদন দেওয়ার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকাটি তুলে দেওয়া হবে। বাকি ছবিটি প্রয়াত কাজী আরেফ আহমদের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করছি।
৭ জুন ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। বাংলাদেশের ‘প্রথম পতাকা’ পলিথিনের কাগজে মুড়িয়ে আমি পল্টন ময়দানে গেলাম। কর্দমাক্ত পল্টন ময়দানে যথাসময়ে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ এগিয়ে এলো। সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, মাথায় বটলগ্রিন ও লাল কাপড়ের লম্বা ক্যাপ ও হাতে লাল-সবুজ কাপড়ের ব্যান্ডে লেখা ‘জয়বাংলা বাহিনী’। ডায়াসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে; সঙ্গে আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদ।
তার ডান পাশে আমি পলিথিনে মোড়ানো পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আ স ম আবদুর রব ডায়াসের সামনে এসে অভিবাদন দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ‘ব্যাটালিয়ন পতাকা’ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে পতাকা নিয়ে খোলা অবস্থায় উপস্থিত জনতাকে দেখিয়ে রবের হাতে তুলে দেন।
রব এ ‘ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ’ সামরিক কায়দায় গ্রহণ করে। পরে মার্চ করে এগিয়ে যায়। ‘জয়বাংলা বাহিনী’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ‘পতাকা’ নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে ইকবাল হলে ফেরত যায়। পতাকাটি তৎকালীন ঢাকা শহর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেনের কাছে রক্ষিত ছিল।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ আনুষ্ঠানিক কুজকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায়। ওইদিন জয়বাংলা বাহিনীকে ৪টি প্লাটুনে ভাগ করে চারজন প্লাটুন কমান্ডারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেদিন জয়বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, কামালউদ্দিন (পরে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অফিসার) ও মনিরুল হক (ঢাকা শহর ছাত্রলীগ সভাপতি)। পতাকা উত্তোলনের মুহূর্তে কামরুল আলম খান খসরুর হাতের ৭ এমএম রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলি করেন। খসরুর পাশে হাসানুল হক ইনু পতাকাটি হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এখান থেকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে গিয়ে তার হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়। তার বাসায় ও গাড়িতে দুটি পতাকা ওড়ানো হয়। এ ‘পতাকা’ই স্বাধীন বাংলাদেশের ‘প্রবাসী সরকার’ অনুমোদনকরণ।”
আমরা মনে করি, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম বুঝতে হলে এ প্রথম পতাকা তৈরি এবং এর সমকালীন গুরুত্ব গভীরভাবে অনুভব করতে হবে। পৌঁছাতে হবে প্রজন্মের কাছে। আইয়ুব খানের শাসনবিরোধী আন্দোলন এক সময় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পরিণত হয়েছিল।
বাঙালির ন্যায়সংগত কোনো দাবিই মূল্য পায়নি পাকিস্তানি শাসকদের কাছে। এর অনিবার্য পরিণতিই ছিল বাঙালির বুকে স্বাধীনতার স্বপ্ন তৈরি হওয়া। তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি প্রবল আস্থা রেখে ১৯৭০-এর জুনেই ছাত্রনেতারা জন্ম দিতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটির।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়