প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সৃষ্টি হয়েছে তথ্য গ্রহণ ও প্রাপ্তির অবাধ বিচরণ। ফলে আমরা নানা তথ্যের ইস্যু নিয়ে প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হচ্ছি।ঠিক একই কারণে প্রিন্ট মিডিয়ার থেকেও বেশি প্রভাবিত করে আমাদের অনলাইন মিডিয়া এবং একই সাথে তাদের মধ্যেও চলছে সবার আগে ‘আপডেট বা ব্রেকিং নিউজ’ নিউজ দেয়ার প্রবণতা।
প্রতিযোগিতামূলক এই তথ্য সরবরাহের ফলে একদিকে যেমন মানুষ সচেতন হচ্ছে তাদের অধিকার আদায়ে আবার অন্যদিকে ভিন্ন আলোচনা তথা নতুন ইস্যু এসে আগের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকেও গুরুত্বহীন করে তুলে। ফলে,আমাদের প্রতিদিনের বঞ্চনা, নানা অধিকার আদায়ের এজেন্ডার দাবী গুলিও বাস্তবায়নের আগেই তা আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে নতুন ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে। আমরা সম্প্রতি দেখেছি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের মত জন গুরুত্বহীন ইস্যুও আমাদের নেটিজেন বা পাঠকদের কাছে সুখাদ্য হতে হতে অখাদ্য বানিয়েছে। অথচ আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় অনেক দাবীই অবহেলায় চাপা পরে যাচ্ছে।যে অর্থনীতি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, সামনের দিনগুলোতে তার মুখে আহার যাবে কি না অথবা বর্তমান বাজারমূল্যের ধারাবাহিকতা ঠেকানো না গেলে কিংবা ব্যাংক খাতের রিজার্ভ সরবরাহ থমকে গেলে অথবা পরিকল্পিত প্রকল্পের সফলতা না পেলে প্রায় দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ এশিয়ার সহোদর হয়ে যাবো কি না তা আমরা আলোচনায় আনতে পারছি না।এর দায় একদিকে যেমন আমাদের নেটিজেনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের আর অন্যদিকে রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভ গণমাধ্যমেরও।ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের লাগামহীন বাজার মূল্য বৃদ্ধির যে প্রান্তিক মানুষের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদ সেটাও গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে,এছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা আমরা আলোচনাতেই আনতে ব্যর্থ হচ্ছি।
গত দুটি বছরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সাথে অর্থনৈতিক জীবনকেও ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস। উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করলে এই প্রভাবকে অনেকটাই সফলতার সাথে মোকাবেলা করতে পেরেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার।কোন কোন ক্ষেত্রে বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও দেশের ক্রান্তিলগ্নে যেসব প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা মূলত চৌকস সরকারের বুদ্ধিমত্তারই পরিচায়ক।চিকিৎসা খাতে চিকিৎসক সংকট যেন না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততম সময়ে ৩৯ ও ৪২ তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডাক্তার।আর্থিক স্থবিরতায় যেন দেশের ব্যবসা বাণিজ্য মুখ থুবড়ে না পরে তার জন্য এই কঠিন ও লকডাউন কালীন সংকটময় মুহূর্তেও খোলা রাখা হয় ব্যাংক ও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। জীবনের ঝুকি নিয়ে দায়িত্বে অবিচল ছিলেন ডাক্তার,ব্যাংকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি-বেসরকারী অনেক সংস্থা ও গণমাধ্যম।ফলাফল,সৃষ্টিকর্তার মহান কৃপায় ও সরকারের প্রচেষ্টায় ভয়াবহ যে আশঙ্কার কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO) বার বার ইঙ্গিত দিয়েছিল তার ধারে কাছেও ছিল না বাংলাদেশ। উপরন্তু বেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও মানুষের মাথাপিছু আয়।
এই যে,একটা বৈশ্বিক মহামারীকে পরাজিত করে আমরা আমাদের সফলতাকে ধরে রেখেছি বা অর্থনৈতিক ক্রম উন্নতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তা যেন অনেকটাই বিনা মহামারীতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।হুট করে বেড়ে গেছে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম,দফায় দফায় তেল গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে যানবাহনে চলাচল খরচ। লকডাউন বিহীন সাধারণ জীবন যাপন যেন লকডাউন থেকেও বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে বর্তমান এই সময়ে। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের হাহাকারে দেশে যেন এক নিরব দুর্ভিক্ষের মহামারিতে আক্রান্ত।সরকারের দেয়া সীমিত টিসিবি পন্য নিতে স্বল্প আয়ের মানুষের কাড়াকাড়ি,এসব পণ্য নিতে লাইনে দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের মানুষদেরও।ধারাবাহিক পরিক্রমায় বেড়েছে বাসা ভাড়া থেকে জীবনের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অথচ জাতীয়ভাবে মাথাপিছু আয় বাড়লেও মানুষের ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাবতো পড়েইনি বরং বেড়েছে তার বিপরীত ভোগান্তি। বেতন-ভাতা,দৈনিক শ্রম আয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের আয় স্থির হয়ে আছে শুধু সচল রয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাকা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের হাহাকারে বিভীষিকাময় আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সরকারের করোনা মোকাবেলার অর্জন অথচ খাদ্যের সংকট নেই বাজারে,আড়তে চাল,ডাল, তেল বা প্রয়োজনীয় সবই আছে অথচ মানুষ তা কিনতে পারছে না সব তাদের নাগালের বাইরে।
মানুষের শান্তি এইটুকুই যে তা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে মানুষের এই দুঃখ কষ্ট ও ভোগান্তির কথা। ফলে বুদ্ধিজীবী, সংবাদ মাধ্যম,সরকারের নীতিনির্ধারকরাও নড়েচড়ে বসেছেন।কোন কোন মন্ত্রীকে বাজার পরিদর্শন করতেও দেখা যাচ্ছে আবার সংবাদ মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা কীভাবে করা যায় তা নিয়েও তারা আলোচনা ও সমালোচনা এড়িয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার চাপ অনুভব করছেন।ফলে দিশেহারা মানুষ হয়ে উঠেছে আশাবাদী।
কিন্তু এদেশের অনেক প্রয়োজনীয় ইস্যুই অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠে কোন কোন সময় এবং একটি ইস্যু গিলে খায় আরেকটি ইস্যুকে।আর এই হট ইস্যু বা অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে আড়াল করতেও কোন কোন মহল উৎ পেতে থাকে।আর এই প্রক্রিয়ার সফলতাও আবার নির্ভর করে গণমাধ্যমের স্বচ্ছ ভূমিকার উপর।
সম্প্রতি ‘টিপ’ সংক্রান্ত ঘটনায় সয়লাব হয়েছে ফেইসবুকের মত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহ মূলধারার গণমাধ্যম গুলোও।যে কোন অপরাধের বিরোদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন সোচ্চার হওয়াটাও ইতিবাচক আবার কোন ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। ঘটনা যাইহোক, সেটির এখন আইনি প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে তদন্তনাধীন। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা সহ সরকার ও পুলিশ বাহিনীকেও নানা পদক্ষেপ নিতে তৎপর দেখা যাচ্ছে। কিন্ত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বরাতে যতটুকু জানা যাচ্ছে তাতে ঘটনাটি একেবারেই সাধারণ তর্কাতর্কি বা বাকবিতন্ডা থেকে,যেখানে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের স্ত্রীরও উপস্থিত ছিলেন এবং অভিযোগ কারীর সাথে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের গর্ভবতী স্ত্রীর পা লাগাকে কেন্দ্র করে(সূত্রঃ৭১ টিভি) কিন্তু এটাকে যেভাবে জাতীয় সংস্কৃতি পরিপন্থী বা ইচ্ছাকৃত বখাটেদের ইভিটিজিং,রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন বা মৌলবাদী কর্তৃক সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয় ফৌজদারী অপরাধের দিকে নিয়ে যেয়ে আন্তর্জাতিক রুপ দেয়া হচ্ছে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে ঠেলে দিয়ে বিষয়টি তা নয় এটি অন্তত পরিষ্কার। তবে যেহেতু এটি তদন্তে আছে তাই আমাদের এর থেকে জোরালো মত না দেয়াই ভাল।কিন্ত অবাক হতে হচ্ছে ভারতীয় এক সংবাদ মাধ্যমের খবর দেখে,India today পত্রিকায় সংবাদ করা হয়েছে “টিপ পরার কারণে পুলিশ কর্তৃক এক হিন্দু মহিলাকে জীবন নাশের হুমকি”।বুঝাই যাচ্ছে সাধারণ ইস্যুটি সীমানা পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক খবরেই শুধু না বরং আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাড়িয়েছে।অন্যদিকে, এই ঘটনার আলোচনা শেষ হতে না হতেই স্কুল ছাত্রীদের হিজাব পরায় গালাগালি বা মারধরের অভিযোগ উঠেছে একজন সংখ্যালঘু শিক্ষিকার বিরুদ্ধে,এটি নিয়েও তদন্ত হচ্ছে। এসব ঘটনা সত্যমিথ্যা যাহোক,এই বঙ্গভূমিতে যে অসহিষ্ণু এক অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হতে চলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।বেশিরভাগ ঘটনাই প্রকৃত অর্থে তুচ্ছ যা ডালপালা গজায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে। ফলে,এই যে ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা তা যে কোন সময় সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সংঘাতকেও উসকে দিতে পারে,হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাজিয়ে সুযোগ নিতে পারে যে কোন সুযোগ সন্ধানী মহল।এসব এই উপমহাদেশের ইতিহাসে বারবার পরীক্ষিত ঘটনা,যার ফায়দা লুটে নিতে পারে রাজনৈতিক ও সার্থন্বেশী ধর্মীয় গোষ্ঠী, শুধু হেরে যাবে বরাবরের মত নিত্যদিনের দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠা নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভাব অভিযোগ। আলোচনা থেকে হারিয়ে যাবে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে আত্মহত্যার দড়িতে ঝুলে পরা কুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী অন্তু রায়ের নিথর দেহ, সন্ত্রাসের গুলিতে চাকরির স্বপ্ন দেখা প্রীতির লাশ,পানি না পাওয়ার আক্ষেপে অভিমানে আত্মহুতি দেয়া দুই সাওতাল চাষীর পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, নারায়ণগঞ্জে স্ত্রীর সম্মুখে স্বামীর চোখ তুলে বিভৎস হত্যাকাণ্ডসহ নানা মানবিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। অথচ এই কাজে সবচেয়ে সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে জনগণের জন্য কথা বলা গণমাধ্যম গুলো। তাই ফেইসবুক এক্টিভিস্ট ও গণমাধ্যমের কাছে দাবী ‘টিপ’বাটন টিপেই যেন বন্ধ হয়ে না যায় মানুষের বেচে থাকার দাবীগুলো,দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হারা মানুষের খেই হারিয়ে ফেলা ভবিষ্যৎ অথবা দারিদ্র্যের কাছে স্বপ্ন সঁপে দেয়া আর কোন নতুন অন্তু রায়ের জীবন।
লেখকঃ নাট্যকার ও ব্যাংক কর্মকর্তা।
ইমেইলঃ [email protected]