দুই বাংলার মানুষের শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করতে তৎকালীন কয়েকজন মুসলিম নেতৃবৃন্দের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক ১৯২১ সালে এ বাংলায় তথা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় এদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২’এর ভাষা আন্দোলন,৬২’ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’এর ছয় দফা,৬৯’গণ অভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ এমনকি স্বৈরাচার হটাও আন্দোলন সহ সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ দেশের সব বৈষম্য বিরোধী ঐতিহাসিক সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সবকটি আন্দোলনেই পুরুষদের পাশাপাশি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছে নারী শিক্ষার্থীরাও। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের অবদান ও অংশগ্রহণ ছিল অসামান্য এবং মধ্যরাতেও তারা হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে অন্যায়ের প্রতিবাদে টিএসসি ও রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করে। মোদ্দা কথা, দেশের সব আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রী তথা নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল সাহস ও অনুপ্রেরণার অন্যতম হাতিয়ার।
এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে কোন আন্দোলন বা মিছিলে প্রথম সারিতেই দেখা যায় পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান করতে নারী শিক্ষার্থীদের । এজন্যই বোধ হয় বিদ্রোহী কবি লিখে গিয়েছেন,”এ বিশ্বে যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর” আমাদের মহান সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে এই অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিয়ে সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে।বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নারীদের অধিকার ও অবস্থান দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্বীকৃতি পেয়েছে।একাধিক মন্ত্রীসহ ক্ষমতার প্রধান ও সাবেক বিরোধী এমন কি বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতাও একজন নারী এবং সংসদ পরিচালক মাননীয় স্পিকারের পদেও অলংকৃত করে আছেন একজন নারী ।এছাড়াও অসংখ্য নারী আমলা,সচিব দেশের বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন।
এই যে,নারীদের এত উন্নয়ন আমরা দেখছি তাদের বড় একটা অংশই তার অতীত বিচরণ ক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ নারী আন্দোলন ও উন্নয়নের প্রধান আতুরঘর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সম্প্রতি কয়েকজন ছাত্রী কর্তৃক টিএসসিতে নারী শিক্ষার্থীদের নামাজের জায়গা চাওয়াকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন বাম ধারার ছাত্র সংগঠন এমনকি ছাত্রলীগও নারী শিক্ষার্থীদের দাবীর বিরোধিতা করে মিছিলসহ নানা কর্মসূচি দিতে দেখা গিয়েছে অথচ বিভিন্ন বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় এই সংগঠন গুলোকেই বেশি সোচ্চার হতে দেখা যায় কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমরা দেখছি তাদের উলটো চিত্র।
যে জায়গাটিকে ঘিরে এই আলোচনা সেই জায়গার একটি অংশে অনেক আগে থেকেই টিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারী,দর্শনার্থী ও ছাত্ররা নামাজ পড়ে আসছে কোন ধরনের বাধা,বিপত্তি ও বিতর্ক ছাড়াই। টিএসসির মত বড় জায়গায় যেখানে নামাজের জন্য কোন মসজিদ নেই সে ক্ষেত্রে এটাই হয়ে আসছিল অস্থায়ী ভাবে নামাজের স্থান এবং আমরা লক্ষ করলে দেখবো অনেক অফিস বা ব্যাংকসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যেখানে মসজিদ নেই সেখানে এভাবেই নামাজ আদায় একটি সাধারণ দৃশ্য।এসব স্থান যেহেতু মসজিদ নয় তাই সাধারণ দিন গুলিতে যোহর, আছর বা মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয় এবং অন্যান্য ছুটির দিনে তা বন্ধ থাকে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অডিটোরিয়ামের বহিরাংশের বারান্দা এমনই একটি স্থান।এই বিষয়টি নিয়ে এতদিন কোন কথাও উঠেনি, স্বাভাবিকভাবে উঠার কথাও না।কারণ,অনেক গুলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কেন্দ্রস্থল ও অফিস এই টিএসসিতে। ফলে,বিভিন্ন জায়গা থেকেই স্বন্ধ্যার পরেও এখানে তারা অবস্থান করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ কিছুটা দূর হওয়ায় অনেকেই এখানে নামাজ আদায় করেন, বিশেষ করে মাগরিবের নামাজের মত সংক্্ষিপ্ত সময়ের নামাজ।তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নবীন বরণ,রি-ইউনিয়নের মত প্রোগ্রামেও অংশ নেন অনেক সাবেক শিক্ষার্থীরা।এদেরও বড় একটা অংশ নারী।এছাড়াও রোজা এলেই প্রায় সারা মাসই বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার পার্টি থাকে এবং প্রায় সব গুলোই বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগঠন কেন্দ্রিক।
স্বভাবতই ইফতারের পর এখানে সবাই নামাজ আদায় করেন কিন্ত এই সুযোগ থেকে অলিখিত এবং প্রথাগতভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছেন নারী শিক্ষার্থীরা,তাদের নামাজের জায়গা নেই এবং তাদের নামাজ আদায় করতে হলে সন্ধ্যার জনাকীর্ণ ভীড় ঠেলে যেতে হবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর পাশে কেন্দ্রীয় মসজিদে যা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকটাই অসম্ভব ।ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত থাকায় অনেক সময় তারা নামাজ আদায়ের মত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কাজ সম্পন্ন করা থেকে বঞ্চিত হন।অনেক নারী শিক্ষার্থীর দাবী বিশেষ করে বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত যারা,তারা দুপুরে লাঞ্চ করতে এসেও নামাজ পড়তে আর সেন্ট্রাল মসজিদের মত উল্টো পথে যেতে পারেন না বা সময়ও থাকে না।তাই এই সমস্যা সমাধানে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যকে স্বারক লিপি প্রদান করেন টিএসসি কেন্দ্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কিছু নারী শিক্ষার্থীরা;যারা “বাধনের” মত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন করে আসছেন।তাদের দেয়া স্বারক লিপি ও দাবীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে মাননীয় উপাচার্য মহোদয় বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের ইতিবাচক সারাও দেন।ফলে সাময়িকভাবে অডিটোরিয়ামের বারান্দার পাশেই পুরুষদের নামাজের জায়গার কাছেই পর্দা টানিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের নামাজের স্থান করে নেন নিজ উদ্যোগে।
কিন্ত হুট করেই এটিকে বিতর্কিত করতে কিছু সংগঠন এই দাবীর বিরোধিতাসহ হাস্যকর ভাবে মৌলবাদের মত অনাকাঙ্ক্ষিত অভিযোগ উপস্থাপন করে মিছিল ও সভা আয়োজন করেন ছাত্রলীগের মত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এই বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদের একটি অংশ;অথচ এই ছাত্রসংগঠনের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হলো নারীর অধিকার আদায়সহ সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং অতীতে আমরা সেটাই দেখে এসেছি। অথচ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অনেক নেতাকেই দেখা যাচ্ছে তারা নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে তো দূরে থাক বরং বাম গড়ানার বক্তব্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের অপমান ও অপরাধী করার চেষ্টা করেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে হুমকি দিতেও দেখা যায়।তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে যেন বাম ছাত্রসংগঠন গুলোর ছত্রছায়ায় বিলীন হতে চলেছে এই সংগঠনের সংগ্রামী অতীত। আরও লজ্জা ও আতঙ্কের বিষয় এই সুনিয়ন্ত্রিত টিএসসির ভেতরে ঢুকে রাতের আধারে নারী শিক্ষার্থীদের নামাজের জায়গার মত ধর্মীয় স্পর্শকাতর নামাজের স্থানটিকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছেন কোন একটি ‘সন্ত্রাসী মহল’।আমরা বর্তমানে আগ্রাসী ইসরায়েল কে যেমন ফিলিস্তিন মসজিদ গুলোকে গুড়িয়ে দিতে দেখছি এদেরকেও তাদের সাথে তুলনা করলে অযৌক্তিক হবে না।
অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় হিন্দু-মুসলিম ছাত্রছাত্রী সবাই মিলে সরস্বতী পূজার চাদা উত্তোলন থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীদের এক সাথে সরস্বতী অনুষ্ঠানে যোগদান একটি সাধারণ বিষয়। তখনও কিন্ত কোন পক্ষকে ধর্মীয় চর্চার পীঠস্থান বা মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে বলে বিতর্ক ছড়ায় না এবং উচিৎও না আর এটাই এই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের উদার সৈন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য। তাহলে নারী শিক্ষার্থীদের নামাজের মতো মৌলিক বিষয়কে যারা মৌলবাদের উত্থান বলে বিতর্ক ছড়াচ্ছে তাদের সংকীর্ণ মানসিকতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ উদার পরিবেশের সাথে বেমানান,তাদের মানসিক দীনতা বরং সাম্প্রদায়িকতাকেই উসকে দিতে পারে এবং তাদের কার্যক্রম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হবে দেশের বৃহৎ স্বার্থে যেন এই সুযোগে অন্য কোন গোষ্ঠী যেন অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির সুযোগ না পায়।
আমাদের দেশ এগিয়েছে, এগিয়েছে আমাদের নারীরাও অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং তা সমাধানে সময় ক্ষেপণ করাটা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের যেমন ব্যর্থতা তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি লজ্জাকর অধ্যায়।তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহবান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং নারীদের প্রতি লজ্জাকর এই বৈষম্য তুলে নিতে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি কারা রাতের আধারে টিএসসির মত নিরাপদ ও সুনিয়ন্ত্রিত স্থানে প্রবেশ করে সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া।একই সাথে সরকারের প্রতি আহবান থাকবে এদেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য হ্রাসের পাশাপাশি নারীর উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ণের যে বৈশ্বিক স্বীকৃতি আমরা লাভ করেছি তা যেন কোন অর্বাচীন ষড়যন্ত্র ভুল প্রমাণ করতে না পারে সেদিকে নজর দেয়া এবং একই সাথে ছাত্রলীগের মধ্যে যারা বাম রাজনীতির অনুপ্রবেশকারী রয়েছে তাদের চিণহিত করে ছাত্রলীগকে কলঙ্কমুক্ত রাখা। পাশাপাশি ছাত্রলীগকেও ভুলে গেলে চলবে না এই বাম রাজনীতির অরাজকতা বন্ধ করতেই বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বাকশাল গঠনের মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।অতএব তারা যেন কতিপয় নাম সর্বস্ব সংগঠন নেতাদের দ্বারা বিভ্রান্ত না হন বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান হোক সবার আগে।দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে সোনালী অতীতের সংগ্রামী প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরের প্রতীক। সেটাই প্রত্যাশা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রসংগঠন গুলোর কাছে।
লেখকঃ নাট্যকার ও কলামিস্ট।