দেখতে দেখতে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের তৃতীয় মেয়াদের ৩ বছর সম্পন্ন করে ফেলেছে। আর মাত্র ২ বছর পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে টাটা চতুর্থ বিজয় অর্জন করতে আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। সে চ্যালেঞ্জ যতটা না প্রতিপক্ষ শিবির বা বিরোধী দল থেকে আসছে তার চেয়ে বেশি আসছে নিজেদের ভুল-ত্রুটি শোধরানোতেই।
২০২০ সালে বিশ্বের মাত্র ২২টি দেশে ধনাত্মক জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তারমধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। প্রায় সবদেশের রপ্তানি কমলেও আগের বছরের তুলনায় আমাদের রপ্তানি বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩৫ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার, জ্বালানি চাহিদাও বেড়েছে, যা অগ্রগতির প্রতীক।
সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ করোনা মহামারি মোকাবিলায় উপমহাদেশে সবচেয়ে সক্ষম এবং পৃথিবীতে ২০তম। ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ থেকে দারিদ্র্যের হার কমে এখন ২০ শতাংশের নিচে, এবং অতিদারিদ্র্যের হার ২৪.২৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে, গড় আয়ু ৬৫ বছর থেকে হয়েছে ৭৩.২ বছর, যা ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়েও অনেক বেশি।
সবচেয়ে বড় বিষয় উন্নয়নের সবগুলো সূচকেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না দেশ স্বাধীনের পর প্রথম ৪০ বছরে এই দেশে যত উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছে পরের ১০ বছরে। তারপরও জনমনে অসন্তুষ্টি লক্ষ্যণীয়।যে বড় দুই কারণে সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করার পরও জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারছে না তার পেছনে আমি নিচের দুটো কারণকে বড় করে দেখছি- ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে নিচের দুটো জায়গায় আওয়ামীলগকে ব্যাপক কাজ করতে হবে।
এক. স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি। যাদের কাছে এই দেশ সোনা দিয়ে মোড়িয়ে দিলেও ভালো লাগবে না। এড়া কোন কারণ ছাড়াই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করবে।
দুই. সীমাহীন দুর্নীতি। ঠিক তখন, যখন আমাদের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের অন্যতম সৎ এবং নিষ্ঠাবান প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছেন।এটা সত্য, একটা পরিবারে সবাই ভালো হবে না। কৌশলগত কারণে আমলাদের দুর্নীতি থামানো সম্ভব হয়ে উঠছে না। কিন্তু এমপি, মন্ত্রীরা যদি সৎ এবং নিষ্ঠাবান হন তাহলে কিন্তু আমলাদের পক্ষে দুর্নীতি করা অনেক কঠিন।৩০০ আসনের অনন্তত ২০০ আসনে যদি সৎ এবং জনবান্ধব এমপি থাকেন আমার মনে হয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য জয়লাভ করা কঠিন হবে না। কোন এমপি যদি তার নিজ এলাকায় জনগণের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন, জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণ করে থাকেন সর্বোপরি আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠগুলোকে এক সুতোয় বাঁধতে সমর্থ হন, আমার মনে হয় না দুনিয়ার কোন ষড়যন্ত্র, গুজবতন্ত্র তাকে ফেল করাতে পারবে। মির্জা আজমের কথাই ধরি। তৃণমূলে তুমুল জনপ্রিয় এই নেতা এলাকার জন্য কাজ করেছেন। যার ফলে ইউপি নির্বাচনে সারাদেশে নৌকার ভরাডুবি হলেও জামালুপুরে তাঁর আসনে নৌকার সকল মাঝিই তীরে নোঙর করতে সক্ষম হয়েছে। প্রবাদে আছে সময় গেলে সাধন হয় না। আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ২ বছর সময় বাকি আছে। যথেষ্ট সময়। দলের নেতা-কর্মীরা তো যার যার মত টাকা পয়সার মালিক হয়েছে। এবার দলের হাইকমান্ড থেকে টাইট দেয়া হোক। সম্পদের পাহাড় জনগণের কল্যাণে ব্যয় করতে বাধ্য করা হোক। এটা গেল তৃণমূলের কথা।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সামনের সময়গুলোতে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে যা জনমনে সরকারের প্রতি ক্ষোভ তৈরি করে। দফায় দফায় এটা ওটার দাম বাড়িয়ে জনগণের জীবনকে বিভীষিকাময় না করে এমপি, আমলাদের টাকার পাহাড় গড়ার মুখে বাধার দেয়াল তুলে দিতে হবে। সোজা কথা উন্নয়নের সুফল জনগণকে নিশ্চিত করতে হবে। পরিতাপের বিষয় যতই দিন যাচ্ছে সম্পদের কেবল অসম বণ্টনই হচ্ছে। ২০০০ সালে যদি এই দেশের মোট সম্পদের অনুপাত ধনীঃগরীব = ৭৫ঃ২৫ থেকে থাকে তাহলে ২০২২ সালে তা ৮৫ঃ ১৫ হয়ে গেছে। শুধু রাজনীতি নিয়ে পড়লেই হবে না সমাজবিজ্ঞানও পড়তে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা না গেলে কখনই জনমনে স্বস্তি ফিরবে না। আর দফায় দফায় এটা ওটার দাম বাড়িয়ে বৈষম্যের স্টিম রোলারটা জনগণের উপর দিয়ে দিতে হবে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই এই দেশের জন্ম হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও যদি স্বাধনীতার বিপক্ষ শক্তিদের আনাগোনা দেখা যায় এমনকি তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় সেসব দেখতে হয়- তাহলে তার দায়ভার যতটা না স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির তার চেয়ে অনেক বেশি সপক্ষ শক্তির।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভোগের রাজনীতি শেখান নাই ।এমপিদেরকে জনগণের জন্য নিজেকে উজার করে দিতে হবে। না হলে নিজে তো ডুববেনই , সবাইকে নিয়েই ডুববেন।আওয়ামী লীগের প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের একদিকে যেমন ভালো কাজ করতে হবে আরেকদিকে সংগঠনকেও শক্তিশালী করতে হবে।