গ্রামকে বলা হয়ে থাকে শেকড়। আমাদের অস্তিত্বও। সেই গ্রাম নিয়ে ‘গ্রাম মানুষকে গল্প দেয়’ শিরোনামে লিখেছেন লেখক ও প্রাবন্ধিক জাহিদুল ইসলাম রিপান।
গ্রাম মানুষকে গল্প দেয়
গণু মিয়া গত হয়েছেন তা প্রায় বছর পাঁচেক হবে।আমাদের পাড়া হতে পশ্চিমের বিচ্ছিন্ন একটা বাড়িতে গনু মিয়া বাস করতেন।বর্ষা এলে নৌকা ছাড়া গনু মিয়ার কোন গতি ছিল না। তার নৌকাটাও ছিল দশাশই। গনু মিয়া নিজেও যেমন লম্বাচওড়া মানুষ ছিলেন তা নৌকাটাও ছিল তেমন লম্বাচওড়া। বর্ষার মৌসুমে আমরা যারা স্কুলগামী ছিলাম তাদের একটা নিত্যকার কাজ ছিল স্কুল ছুটির শেষে একটা ছাড়া বাড়িতে দাঁড়িয়ে যার যার আত্মীয় স্বজনকে ডাকাডাকি করা।কেউ বাবা,কেউ মা,কেউ ভাইয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকতো।পাড়ার উত্তর দিকে যাদের বাড়ি তাদের বাড়িতে ডাক পৌছাতো না।
তাই দক্ষিণের প্রতিবেশীরা ডাক পৌঁছে দিত কারণ স্কুলের পাড়াটা ছিল দক্ষিণ দিকে।আমাদের পাড়ায় তখন দশঘর লোকের বাস।এই পাড়াটাও ছিল পানি বন্দী। যে রাস্তা ধরে আমরা বাজারে যেতাম তা আজকের মত উঁচু ছিল না।চাষের জমির চেয়ে খানিকটা উঁচু ছিল।বর্ষার শুরুতেই আমরা জলকাদা পাড়িয়ে স্কুলে যেতাম।তবে স্কুল যে বহু ক্রোশ দূরে ছিল তা বলবো না।তিনশো মিটারের মত রাস্তা আমরা হেটে পারি দিতাম।বর্ষা বাড়লে হেটে যাওয়ার আর জো থাকে না।তখনই শুরু হয় ডাকাডাকি আর হাকাহাকির পালা।স্কুলগামী আমরা তখন দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যেতাম।একদল নৌকা ওয়ালা আরেক দল নৌকা ছাড়া। নৌকা ওয়ালারা তখন খুবই গর্বিত শ্রেণী আর নৌকাহীনেরা নির্ভরশীল শ্রেনী। আমাদের মধ্যে কারো কারো নৌকা ছিল শুধুই স্কুলে যাওয়া আর আসার জন্য। কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ততা কম ছিল বিধায় তাদের বাড়ির অন্যান্য লোকেদের নৌকার তেমন প্রয়োজন ছিল না।কাউসার আহমেদ ছিল এই সৌভাগ্যবানদের একজন। হোসেন মিয়ার মত সে একটি নৌকার মালিক ছিল।তাই ডাকাডাকির কোন পর্ব তার ছিল না।সে অবশ্য অন্য পাড়ার লোক।তবে মাঝেমধ্যে আমাদের পাড়ার কেউ কেউ তার নৌকায় চড়ার সুযোগ পেত।
এক পাড়ায় থাকতে গেলে এর ওর সাথে ঠোকাঠুকি, কথা-কাটাকাটি হয়েই থাকে।ঝগড়ার ইস্যু খুব বড় থেকে নিতান্তই তুচ্ছ হয়ে থাকে।কিন্তু সেই ঝগড়ার ঝাঁঝ বর্ষাকালে নৌকায় গিয়ে পরে।যে দুই পরিবারের মাঝে ঝগড়ার স্মৃতি খুবই সতেজ তাদের সন্তানেরা একে অন্যের নৌকায় চড়ে না।হয়তো একটি পরিবারের নৌকাই নেই।তখন তাকে বিকল্প কোন পথ খুঁজতে হয়।স্কুল ছুটির পর হয়তো সে আধা ঘন্টা বসে থাকে তারপরও বিপক্ষ দলের নৌকায় উঠে না।সহপাঠীরা সাধাসাধি করলেও উঠে না।কারণ উঠলেই বাড়িতে গিয়ে বড়দের কথা শুনতে হবে।এভাবেই পুরোটা বর্ষার মৌসুম সে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ কারো নৌকায় যাতায়াত করে।
কিন্তু গণু মিয়ার নৌকার হিসেব আলাদা। এটা ছিল পুরাই গণমানুষের নৌকা আর আকারে সবার চেয়ে বড়।খেতে খামারের কাজে লাগতো বলে সে নৌকা স্কুলফেরত ছাত্র-ছাত্রীদের আনতে সব সময় পাওয়া যেত না।কিন্তু যেদিন যেত সেদিন পাড়ার সব পোলাপাইনদের ঠাই হত তার নৌকায়। গনু মিয়ার নৌকা আসতে দেখলে সবার ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে যেত।এই গণু মিয়া ছিল বেশ গল্পবাজ। তার মুখে শোনা কোন গল্পই অবশ্য আমাদের বিশ্বাস হত না।আমরা আড়ালে আবডালে গিয়ে বলতাম ডাব মারে।একবার সে কোন এক বন্যার কথা বলছিল।ঘটনা তার শেষ যৌবনের। আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে কোথাও গিয়েছিল। সম্ভবত নৌকা বাইচ দেখতে। ফিরতি পথে তাদের নৌকা ডুবে যায়।সবাই সাতার জানা গায়ের লোক।
সুতরাং নৌকা জাগাতে তাদের বেগ পেতে হয়নি।কিন্তু সেই সদ্য জাগানো নৌকায় নাকি তারা অনেকগুলো কৈ মাছ পেয়েছিল।২০০৬ সালের দিকে তার মুখে শোনা এমন কথা নিতান্ত কান পাতলা লোকেও বিশ্বাস করবে না।আমাদের তো একদমই বিশ্বাস হয়নি।কিন্তু অমন দাঁড়ি পাকা মুরব্বির সামনে তারই জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস আমাদের হত না। তাই গল্পের আসর ভাঙলে আমরা বাড়ি ফেরার পথে সেই গল্পের পুরোটাই যে ডাব তা নিয়ে একমত প্রকাশ করতাম আর কিছুটা বালকসুলভ হাসাহাসি করতাম।কিন্তু আজ ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে যখন নিজের জীবনের কুড়ি বছর আগের ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো রোমন্থন করি, তখন ভাবি এ যদি বর্তমান প্রজন্মকে বলি তবে আমাকেও চাপাবাজ বলবে।
গনু মিয়ার জীবনের গল্প যেমন কুড়ি বছর পরে আমাদের কাছে নিছক গপ্পো হয়ে ধরা দিয়েছিল, ঠিক তেমনি আমার জীবনের গল্পও বর্তমান প্রজন্মের গাছে আরেকটি নতুন গপ্প মাত্র।শুধু গপ্পের চরিত্র ভিন্ন।আমার চাচার সাথে ঠেলা জাল দিয়ে ধানী জমিতে জট পাকানো কস্তুরির ঝাকে খেও দিয়ে যে পরিমাণ কৈ,শিং,টাকি,বাইন,খলসে,মেনি মাছ এক ঘন্টায় ধরেছি তা আজ গপ্পের মতই শোনাবে।৫০ মিটার চওড়া একটা খালের এপার থেকে ওপারে ছোট্ট একটা ঠেলা জাল ঠেলে ছোট পাতিলের এক পাতিল গুড়া চিংড়ি ধরেছি তা আজ কে বিশ্বাস করতে চাইবে?।বর্ষার শেষে ইরি জমিতে আটকে পরা পানিতে জাল টেনে যে বৈঁচা মাছ ধরেছি বা জমির পানি খালে নামার মুখে চাই পেতে হাড়িতে হাড়িতে দেশী পুঁটি মাছ মানুষ ধরতো তা আজ প্রমাণ সাইজের গপ্প।গ্রামের মানুষ যে বর্ষার শেষের দিকে ধৃত এত মাছ খেতে না পেরে শুকিয়ে শুটকি বানাতো তা আজ আলাদীনের গল্পের মত শোনাবে।গনু মিয়ারা তাদের গল্প নিয়ে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছেন।
আমরাও আমাদেরটা নিয়ে বিলীন হব।”প্রতিটি গ্রাম হবে শহর” স্লোগান নিয়ে বর্তমান প্রজন্ম আগামীর সময়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।তাদের বর্তমান স্মৃতি আবার নতুন গল্পের জন্ম দিবে, যা তার উওর প্রজন্মের কাছে গপ্পো হয়ে ধরা দিবে।বৈচা ধরা জমিতে হয়তো কোন এক কালে আরেক বুর্জ দুবাই উঠবে।রঙিন বৈচা সে অট্টালিকার উঁচু তলার একুরিয়ামে ছোট্ট শিশুর মনোযোগ কাড়বে।