হতদরিদ্র অদম্য মেধাবী কাজল মন্ডলের মেডিক্যালে ভর্তি ও লেখপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন খুলনার চৌগাছা উপজেলার ইউএনও ইরুফা সুলতানা। খবরটি প্রকাশের পরপরই দেশজুড়ে প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। বিডিনিউজ ট্র্যাকারের অনুসন্ধানে জানা যায় স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে প্রথম কাজল মন্ডলের সম্পর্কে জানতে পারেন চৌগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। খবরটি জানার পরই তিনি নিজে কাজল মন্ডলের বাড়ি গিয়ে কাজল মন্ডল ও তার পিতা মাতার সাথে দেখা করে তাদেরকে সংবর্ধনা দেন। সংবর্ধনার পর তিনি যখন কাজল মন্ডলের মেডিক্যাল ভর্তি ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবার কথা জানান তখন কাজল মন্ডলের মা-বাবা আবেগ ধরে রাখতে পারেনি। এতটাই খুশি হন তারা কেঁদে ফেলেন।
লেখাপড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়া চৌগাছা উপজেলার রাণীয়ালি গ্রামের সুধাংশু কুমার মণ্ডল ও রেবা রানী মণ্ডল দম্পতিকে মিষ্টিমুখও করান এই মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এর আগে করোনাকালের শুরু থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে জনসাধারণকে সচেতন করতে এবং কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েও প্রশংসিত হয়েছিলেন ইরুফা সুলতানা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা কাজলের মায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলে তাকে কোনো অবস্থাতেই মনোবল না হারাতে বলেন। তিনি কাজলদের পরিবারের খোঁজখবর নেন এবং তার ভর্তির খরচ নিজে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের মোবাইল নম্বর কাজলের মায়ের কাছে দিয়ে যেকোনো প্রয়োজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজলের লেখাপড়ার অন্যান্য সব বিষয়ে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন তাদের পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানার কাছে বিডিনিউজ ট্র্যাকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলার অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের দেখাশুনা করাকেও আমি দায়িত্ব মনে করি। এরকম একটা মানবিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরে অসম্ভব ভালো লাগছে- যোগ করেন ইরুফা সুলতানা।
মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া কাজল মণ্ডল উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের রাণিয়ালী গ্রামের সুধাংশু কুমার মণ্ডলের ছেলে। তারা দুই ভাইবোন। বড় বোন ঝিনাইদহের কেসি কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন।
রেবা রানী মণ্ডল জানান, তাদের সামান্য ভিটাবাড়ি টুকুই আছে। আর কোনো জমি নেই। কাজলের বাবা পরের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। একটি পাটখড়ির দেয়ালে টিনের ছাউনি দেওয়া ঝুপড়ি ঘরে তারা বসবাস করেন।
কাজল মণ্ডল জানান, ২০১৯ সালে গ্রামের রাণিয়ালী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শত অভাবের পরও যশোর সরকারি সিটি কলেজে তাকে ভর্তি করে তার পরিবার। সেখানে একটি ছোট বাসা ভাড়া নেওয়া হয়। কাজলের মা রেবা রানী শহরে ছেলেকে রান্না করে দেওয়ার জন্য সেখানে থেকে শহরের বিত্তবানদের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ছেলের ঘরভাড়া ও কোচিংয়ের খরচ জোগান দেন।
অন্যদিকে বাবা সুধাংশু বাড়িতে দুই বছর একা পরের ক্ষেতে কাজ শেষে ফিরে রান্না করে খেয়েছেন এবং ঝিনাইদহের কেসি কলেজে পড়ুয়া মেয়ের খরচ জুগিয়েছেন।
সুধাংশু মণ্ডল বলেন, আমার দুই সন্তানই ছোটবেলা থেকেই মেধাবী হওয়ায় স্ত্রী রেবার উৎসাহে শত অভাবের মধ্যেও ওদের লেখাপড়া বাদ দিতে বলিনি। স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। গ্রামের মেম্বার (ইউপি সদস্য) গোবিন্দ কুমার কাজলের এসএসসির ফরম পূরণের সব খরচ বহন করেছেন। ইউপি চেয়ারম্যান অবাইদুল ইসলাম সবুজ যথাসাধ্য পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন।
শনিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা মিস্টি নিয়ে তার বাড়িতে গেলে কাজলের মা রেবা রানী মণ্ডল বারবার আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলছিলেন। এ সময় কাজলের বাবা অন্যের ক্ষেতে কাজ করছিলেন। কাজলের মা রেবা মণ্ডল ইউএনওকে বলেন, অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। এখন আপনারা একটু সহযোগিতা করলে… বলতে বলতে আবারো কেঁদে ফেলেন। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে সাহস দিয়ে বলেন, কোনো অবস্থাতেই ভেঙে পড়বেন না। আমিসহ উপজেলা ও জেলা প্রশাসন আপনার পাশে আছে। আপনি একজন রত্নগর্ভা মা।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, অদম্য মেধাবী কাজলের পাশে চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন ও যশোর জেলা প্রশাসন সবসময় থাকবে। জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। কাজলের ভর্তির টাকা আমি নিজে দেব। তার লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি বলেন, কাজলদের জীর্ণ কুটির দেখেছি। কাজলের বাবা-মাকে সরকারি একটি বাড়ি দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।